পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা
আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা
বাহিরে অন্তরে ঝড় উঠিয়াছে
আশ্রয় যাচি হায় কাহার কাছে!
বুঝি দুখ নিশি মোর
হবে না হবে না ভোর
ফুটিবে না আশার আলোক রেখা।।
Sunday, 17 June 2012
তুমি আমার সকালবেলার সুর
তুমি আমার সকালবেলার সুর
বিদায় আলোয় উদাস করা অশ্রুভারাতুর।
ভোরের তারার মতো তোমার সজল চাওয়ায়
ভালোবাসা চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়
রাত্রিশেষের চাঁদ তুমি গো, বিদায়বিধুর।
তুমি আমার ভোরের ঝরা ফুল
শিশির নাওয়া শুভ্রশুচি পূজারিণীতুল।
অরুণ তুমি তরুণ তুমি করুণ তারও চেয়ে
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ লোকের মেয়ে
তুমি ইন্দ্রসভার মৌনবীণা নীরবনিঠুর।।
বিদায় আলোয় উদাস করা অশ্রুভারাতুর।
ভোরের তারার মতো তোমার সজল চাওয়ায়
ভালোবাসা চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়
রাত্রিশেষের চাঁদ তুমি গো, বিদায়বিধুর।
তুমি আমার ভোরের ঝরা ফুল
শিশির নাওয়া শুভ্রশুচি পূজারিণীতুল।
অরুণ তুমি তরুণ তুমি করুণ তারও চেয়ে
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ লোকের মেয়ে
তুমি ইন্দ্রসভার মৌনবীণা নীরবনিঠুর।।
তিলক দিলে কি শ্যাম
তিলক দিলে কি শ্যাম ত্রিলোক ভুলাতে?
কে দিল বনমালী বনমালা গলাতে?
আঁখি যেন ঢলঢল আধফোটা শতদল
কে শিখাল ও চাহনি গোপিনী ছলিতে?
কে দিল বনমালী বনমালা গলাতে?
আঁখি যেন ঢলঢল আধফোটা শতদল
কে শিখাল ও চাহনি গোপিনী ছলিতে?
গভীর রাতে জাগি
গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে
দূর গগনে প্রিয় তিমির-পারে।
জেগে যবে দেখি বঁধু তুমি নাই কাছে
আঙিনায় ফুটে ফুল ঝরে পড়ে আছে
বাণ-বেঁধা পাখী সম আহত এ প্রাণ মম
লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে অন্ধকারে।
মৌনা নিঝুম ধরা ঘুমায়েছে সবে
এসো প্রিয় এই বেলা বক্ষে নীরবে।
কত কথা কাঁটা হয়ে বুকে আছে বিঁধে
কত আভিমান কত জ্বালা এই হূদে
দেখে যাও এসো প্রিয় কত সাধ ঝরে গেল
কত আশা মরে গেল হাহাকারে।।
দূর গগনে প্রিয় তিমির-পারে।
জেগে যবে দেখি বঁধু তুমি নাই কাছে
আঙিনায় ফুটে ফুল ঝরে পড়ে আছে
বাণ-বেঁধা পাখী সম আহত এ প্রাণ মম
লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে অন্ধকারে।
মৌনা নিঝুম ধরা ঘুমায়েছে সবে
এসো প্রিয় এই বেলা বক্ষে নীরবে।
কত কথা কাঁটা হয়ে বুকে আছে বিঁধে
কত আভিমান কত জ্বালা এই হূদে
দেখে যাও এসো প্রিয় কত সাধ ঝরে গেল
কত আশা মরে গেল হাহাকারে।।
কেমনে রাখি আঁখিবারি চাপিয়া
রাগ - রাগেশ্রী
কেমনে রাখি আঁখিবারি চাপিয়া
প্রাতে কোকিল কাঁদে, নিশীথে পাপিয়া।
এ ভরা ভাদরে আমারি মরা নদী
উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি
আমার এ ভাঙ্গা ঘাটে আমার এ হূদি তটে
চাপিতে গেলে ওঠে দুকুল ছাপিয়া।
নিষেধ নাহি মানে আমার এ পোড়া আঁখি
জল লুকাব কত কাজল মাখি মাখি
ছলনা করে হাসি অমনি জলে ভাসি
ছলিতে গিয়া আসি ভয়েতে কাঁপিয়া।।
কেমনে রাখি আঁখিবারি চাপিয়া
প্রাতে কোকিল কাঁদে, নিশীথে পাপিয়া।
এ ভরা ভাদরে আমারি মরা নদী
উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি
আমার এ ভাঙ্গা ঘাটে আমার এ হূদি তটে
চাপিতে গেলে ওঠে দুকুল ছাপিয়া।
নিষেধ নাহি মানে আমার এ পোড়া আঁখি
জল লুকাব কত কাজল মাখি মাখি
ছলনা করে হাসি অমনি জলে ভাসি
ছলিতে গিয়া আসি ভয়েতে কাঁপিয়া।।
আমার কালো মেয়ে
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে
কে দিয়েছে গালি
তারে কে দিয়েছে গালি
রাগ করে সে সারা গায়ে
মেখেছে তাই কালি।
যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে
আরো মধুর লাগে তাহার হাসিমুখের চেয়ে
কে কালো দেউল করে আলো
অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি।
পরেনি সে বসনভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ
তারি কাছে হার মানে রে ভুবনমোহন বেশ।
রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে
দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে
আমার রাগী মেয়ে, তাই তারে দিই
জবা ফুলের ডালি।।
কে দিয়েছে গালি
তারে কে দিয়েছে গালি
রাগ করে সে সারা গায়ে
মেখেছে তাই কালি।
যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে
আরো মধুর লাগে তাহার হাসিমুখের চেয়ে
কে কালো দেউল করে আলো
অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি।
পরেনি সে বসনভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ
তারি কাছে হার মানে রে ভুবনমোহন বেশ।
রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে
দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে
আমার রাগী মেয়ে, তাই তারে দিই
জবা ফুলের ডালি।।
Saturday, 16 June 2012
আসিবে তুমি জানি প্রিয়
আসিবে তুমি জানি প্রিয়
আনন্দে বনে বসন্ত এলো
ভুবন হল সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর।
বনানতে পবন অশান্ত হল তাই
কোকিল কুহরে, ঝরে গিরি নির্ঝরিণী ঝর ঝর।
ফুল্ল যামিনী আজি ফুল সুবাসে
চন্দ্র অতন্দ্র সুনীল আকাশে
আনন্দিত দীপান্নিত অম্বর।
অধীর সমীরে দিগঞ্চল দোলে
মালতী বিতানে পাখি পিউ পিউ বোলে
অঙ্গে অপরূপ ছন্দ আনন্দ-লহর তোলে
দিকে দিকে শুনি আজ আসিবে রাজাধিরাজ
প্রিয়তম সুন্দর।।
আনন্দে বনে বসন্ত এলো
ভুবন হল সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর।
বনানতে পবন অশান্ত হল তাই
কোকিল কুহরে, ঝরে গিরি নির্ঝরিণী ঝর ঝর।
ফুল্ল যামিনী আজি ফুল সুবাসে
চন্দ্র অতন্দ্র সুনীল আকাশে
আনন্দিত দীপান্নিত অম্বর।
অধীর সমীরে দিগঞ্চল দোলে
মালতী বিতানে পাখি পিউ পিউ বোলে
অঙ্গে অপরূপ ছন্দ আনন্দ-লহর তোলে
দিকে দিকে শুনি আজ আসিবে রাজাধিরাজ
প্রিয়তম সুন্দর।।
এ কুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে
এ কুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে
এই তো নদীর খেলা (রে ভাই)
এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই
ফকীর সন্ধ্যাবেলা।
সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা।
এই দেহ ভেঙ্গে হয় রে মাটি
মাটিতে হয় দেহ
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ
তার খোঁজ নিল না কেহ।
রাতে রাজা সাজে নট-মহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে
শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে
সবই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই
ভব-নদীর খেলা।।
এই তো নদীর খেলা (রে ভাই)
এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই
ফকীর সন্ধ্যাবেলা।
সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা।
এই দেহ ভেঙ্গে হয় রে মাটি
মাটিতে হয় দেহ
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ
তার খোঁজ নিল না কেহ।
রাতে রাজা সাজে নট-মহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে
শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে
সবই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই
ভব-নদীর খেলা।।
ওই ঘর ভুলানো সুরে
ওই ঘর ভুলানো সুরে
কে গান গেয়ে যায় দূরে
তার সুরের সাথে সাথে
মোর মন যেতে চায় উড়ে।
তার সহজ গলার তানে
সে ফুল ফোটাতে জানে
তার সুরে ভাটির টানে
নব জোয়ার আসে ঘুরে।
তার সুরের অনুরাগে
বুকে প্রণয়-বেদন জাগে
বনে ফুলের আগুন লাগে
ফুল সুধায় ওঠে পুরে।
বুঝি সুর সোহাগে ওরই
পায় যৌবন কিশোরী
হিয়া বুঁদ হয়ে গো নেশায়
তার পায়ে পায়ে ঘুরে।।
কে গান গেয়ে যায় দূরে
তার সুরের সাথে সাথে
মোর মন যেতে চায় উড়ে।
তার সহজ গলার তানে
সে ফুল ফোটাতে জানে
তার সুরে ভাটির টানে
নব জোয়ার আসে ঘুরে।
তার সুরের অনুরাগে
বুকে প্রণয়-বেদন জাগে
বনে ফুলের আগুন লাগে
ফুল সুধায় ওঠে পুরে।
বুঝি সুর সোহাগে ওরই
পায় যৌবন কিশোরী
হিয়া বুঁদ হয়ে গো নেশায়
তার পায়ে পায়ে ঘুরে।।
বঁধু, মিটিলনা সাধ
বঁধু, মিটিলনা সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়
তাই আবার বাসিতে ভালো আসিব ধরায়।
আবার বিরহে তব কাঁদিব
আবার প্রণয় ডোরে বাঁধিব
শুধু নিমেষেরি তরে আঁখি দুটি ভ’রে
তোমারে হেরিয়া ঝ’রে যাব অবেলায়।
যে গোধূলি-লগ্নে নববধূ হয় নারী
সেই গোধূলি-লগ্নে বঁধু দিল আমারে গেরুয়া শাড়ি
বঁধু আমার বিরহ তব গানে
সুর হয়ে কাঁদে প্রাণে প্রাণে
আমি নিজে নাহি ধরা দিয়ে
সকলের প্রেম নিয়ে দিনু তব পায়।।
তাই আবার বাসিতে ভালো আসিব ধরায়।
আবার বিরহে তব কাঁদিব
আবার প্রণয় ডোরে বাঁধিব
শুধু নিমেষেরি তরে আঁখি দুটি ভ’রে
তোমারে হেরিয়া ঝ’রে যাব অবেলায়।
যে গোধূলি-লগ্নে নববধূ হয় নারী
সেই গোধূলি-লগ্নে বঁধু দিল আমারে গেরুয়া শাড়ি
বঁধু আমার বিরহ তব গানে
সুর হয়ে কাঁদে প্রাণে প্রাণে
আমি নিজে নাহি ধরা দিয়ে
সকলের প্রেম নিয়ে দিনু তব পায়।।
ভুলিতে পারিনে তাই
ভুলিতে পারিনে তাই আসিয়াছি পথ ভুলি
ভোলো মোর সে অপরাধ, আজ যে লগ্ন গোধূলি।
এমনি রঙিন বেলায় খেলেছি তোমায় আমায়
খুঁজিতে এসেছি তাই সেই হারানো দিনগুলি।
তুমি যে গেছ ভুলে, ছিল না আমার মনে
তাই আসিয়াছি তব বেড়া দেওয়া ফুলবনে
গেঁথেছি কতই মালা এই বাগানের ফুল তুলি
আজও হেথা গাহে গান আমার পোষা বুল্বুলি।
চাহ মোর মুখে প্রিয়, এস গো আরও কাছে
হয়তো সে দিনের স্মৃতি তব নয়নে আছে
হয়তো সে দিনের মতই প্রাণ উঠিবে আকুলি।।
ভোলো মোর সে অপরাধ, আজ যে লগ্ন গোধূলি।
এমনি রঙিন বেলায় খেলেছি তোমায় আমায়
খুঁজিতে এসেছি তাই সেই হারানো দিনগুলি।
তুমি যে গেছ ভুলে, ছিল না আমার মনে
তাই আসিয়াছি তব বেড়া দেওয়া ফুলবনে
গেঁথেছি কতই মালা এই বাগানের ফুল তুলি
আজও হেথা গাহে গান আমার পোষা বুল্বুলি।
চাহ মোর মুখে প্রিয়, এস গো আরও কাছে
হয়তো সে দিনের স্মৃতি তব নয়নে আছে
হয়তো সে দিনের মতই প্রাণ উঠিবে আকুলি।।
মধুকর মঞ্জীর বাজে
মধুকর মঞ্জীর বাজে বাজে গুন্ গুন্ মঞ্জুল গুঞ্জরণে
মৃদুল দোদুল নৃত্যে বন শবরী মাতে কুঞ্জবনে।
বাজায়ছে সমীর দখিনা
পল্লবে মর্মর বীণা
বনভুমি ধ্যান-আসীনা
সাজিল রাঙা কিশলয় বসনে।
ধূলি-ধূসর প্রান্তর পরেছিল গৈরিক সন্ন্যাসী সাজ
নব দূর্বাদল শ্যাম হলো আনন্দে আজ।
লতিকা বিতানে ওঠে ডাকি
মুহু মুহু ঘুমহারা পাখি
নব নীল অঞ্জন মাখি
উদাসী আকাশ হাসে চাঁদের সনে।।
মৃদুল দোদুল নৃত্যে বন শবরী মাতে কুঞ্জবনে।
বাজায়ছে সমীর দখিনা
পল্লবে মর্মর বীণা
বনভুমি ধ্যান-আসীনা
সাজিল রাঙা কিশলয় বসনে।
ধূলি-ধূসর প্রান্তর পরেছিল গৈরিক সন্ন্যাসী সাজ
নব দূর্বাদল শ্যাম হলো আনন্দে আজ।
লতিকা বিতানে ওঠে ডাকি
মুহু মুহু ঘুমহারা পাখি
নব নীল অঞ্জন মাখি
উদাসী আকাশ হাসে চাঁদের সনে।।
যাও যাও তুমি ফিরে
যাও যাও তুমি ফিরে, এই মুছিনু আঁখি
কে বাঁধিবে তোমারে, হায় বনের পাখি।
মোর এত প্রেম আশা, মোর এত ভালোবাসা
আজ সকলি দুরাশা, আর কি দিয়ে রাখি।
এই অভিমান জ্বালা, মোর একেলারি কালা
ßান মিলনেরি মালা, দাও ধুলাতে ঢাকি।
তোমার বেঁধেছিল নয়ন শুধু এ রূপের জালে
তাই দু দিন কাঁদিয়া হায় সে বাঁধন ছাড়ালে।
মোর বাঁধিয়াছে হিয়া, তায় ছাড়াব কি দিয়া
সখা হিয়া ত নয়ন নহে
সে ছাড়ে না কাঁদিয়া, দু দিন কাঁদিয়া।
আজ যে ফুল প্রভাতে হায় ফুটিল শাখাতে
তায় দেখিল না রাতে, সে ঝরিল নাকি।
হায় রে কবি প্রবাসী, নাই হেথা সুখ হাসি
ফুল ঝরে হলে বাসি, রয় কাঁটার ফাঁকি।।
কে বাঁধিবে তোমারে, হায় বনের পাখি।
মোর এত প্রেম আশা, মোর এত ভালোবাসা
আজ সকলি দুরাশা, আর কি দিয়ে রাখি।
এই অভিমান জ্বালা, মোর একেলারি কালা
ßান মিলনেরি মালা, দাও ধুলাতে ঢাকি।
তোমার বেঁধেছিল নয়ন শুধু এ রূপের জালে
তাই দু দিন কাঁদিয়া হায় সে বাঁধন ছাড়ালে।
মোর বাঁধিয়াছে হিয়া, তায় ছাড়াব কি দিয়া
সখা হিয়া ত নয়ন নহে
সে ছাড়ে না কাঁদিয়া, দু দিন কাঁদিয়া।
আজ যে ফুল প্রভাতে হায় ফুটিল শাখাতে
তায় দেখিল না রাতে, সে ঝরিল নাকি।
হায় রে কবি প্রবাসী, নাই হেথা সুখ হাসি
ফুল ঝরে হলে বাসি, রয় কাঁটার ফাঁকি।।
সতী হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে
সতী হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে
বিষাণ ত্রিশূল ফেলি গভীর বিষাদে
জটাজুটে গঙ্গা নিস্তরঙ্গা
রাহু যেন গ্রাসিয়াছে ললাটের চাঁদে।
দুই করে দেবী-দেহ ধরে বুকে বাঁধে
রোদনের সুর বাজে প্রণব নিনাদে
ভক্তের চোখে আজি ভগবান শঙ্কর
সুন্দরতর হল পড়ি মায়া ফাঁদে।।
বিষাণ ত্রিশূল ফেলি গভীর বিষাদে
জটাজুটে গঙ্গা নিস্তরঙ্গা
রাহু যেন গ্রাসিয়াছে ললাটের চাঁদে।
দুই করে দেবী-দেহ ধরে বুকে বাঁধে
রোদনের সুর বাজে প্রণব নিনাদে
ভক্তের চোখে আজি ভগবান শঙ্কর
সুন্দরতর হল পড়ি মায়া ফাঁদে।।
সই, ভালো করে বিনোদ-বেণী
সিন্ধু-ভৈরবী / কাহার্বা
সই, ভালো করে বিনোদ-বেণী বাঁধিয়া দে
মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিননী-ফাঁদে।
সই চপল পুরুষ সে, তাই কুরুশ-কাঁটায়
রাখিব খোঁপার সাথে বিঁধিয়া লো তায়
তাহে রেশমী জাল বিছায়ে দে ধরিতে চাঁদে।
বাঁধিতে সে বাঁধন হারা বনের হরিণ
জড়ায়ে দে জরীন্ ফিতা মোহন ছাঁদে
প্রথম প্রণয় রাগের মত আল্তা রঙে
রাঙায়ে দে চরণ মোর এমনি ঢঙে
সই পায়ে ধরে বঁধু যেন আমারে সাধে।।
সই, ভালো করে বিনোদ-বেণী বাঁধিয়া দে
মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিননী-ফাঁদে।
সই চপল পুরুষ সে, তাই কুরুশ-কাঁটায়
রাখিব খোঁপার সাথে বিঁধিয়া লো তায়
তাহে রেশমী জাল বিছায়ে দে ধরিতে চাঁদে।
বাঁধিতে সে বাঁধন হারা বনের হরিণ
জড়ায়ে দে জরীন্ ফিতা মোহন ছাঁদে
প্রথম প্রণয় রাগের মত আল্তা রঙে
রাঙায়ে দে চরণ মোর এমনি ঢঙে
সই পায়ে ধরে বঁধু যেন আমারে সাধে।।
রঙ্গীলা আপনি রাধা
রঙ্গীলা আপনি রাধা
তারে হোরীর রং দিও না
ফাগুনের রাণী যে রাই
তারে রঙে রাঙিয়ো না।
রাঙ্গা আবির রাঙ্গা ঠোঁটে
গালে ফাগের লালী ফোটে
রংসায়রে নেয়ে উঠে
অঙ্গে ঝরে রঙের সোনা।
অনুরাগ-রাঙা মনে
রঙের খেলা ক্ষণে ক্ষণে
অন্তরে যার রঙের লীলা
(তারে) বাহিরে রং লাগিয়ো না।।
তারে হোরীর রং দিও না
ফাগুনের রাণী যে রাই
তারে রঙে রাঙিয়ো না।
রাঙ্গা আবির রাঙ্গা ঠোঁটে
গালে ফাগের লালী ফোটে
রংসায়রে নেয়ে উঠে
অঙ্গে ঝরে রঙের সোনা।
অনুরাগ-রাঙা মনে
রঙের খেলা ক্ষণে ক্ষণে
অন্তরে যার রঙের লীলা
(তারে) বাহিরে রং লাগিয়ো না।।
শাওন আসিল ফিরে
শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না
বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না।
ধানী রং ঘাঘরীর মেঘ রং ওড়না
পরিতে আমারে মাগো অনুরোধ কোরোনা
কাজরী কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া
সে কি ফেরার পথ পেল না মা পেল না?
আমার বিদেশীরে খুঁজিতে অনুখন
বুনোহাঁসের পাখার মতো উড়ু উড়ু করে মন
অথৈ জলে মাগো পথঘাট থৈথৈ
আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?
কদমকেশর বলে কোথা তোর কিশোর
চম্পাডালে ঝুলে শূন্য ঝুলনা।
বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না।
ধানী রং ঘাঘরীর মেঘ রং ওড়না
পরিতে আমারে মাগো অনুরোধ কোরোনা
কাজরী কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া
সে কি ফেরার পথ পেল না মা পেল না?
আমার বিদেশীরে খুঁজিতে অনুখন
বুনোহাঁসের পাখার মতো উড়ু উড়ু করে মন
অথৈ জলে মাগো পথঘাট থৈথৈ
আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?
কদমকেশর বলে কোথা তোর কিশোর
চম্পাডালে ঝুলে শূন্য ঝুলনা।
মন বলে তুমি আছ ভগবান
মন বলে তুমি আছ ভগবান
চোখ বলে তুমি নাই
মিছে শুধু তোমায় ডেকে ডেকে মরি
দেখা কভু নাহি পাই।
মন বলে ঐ তৃণ-লতা-গাছে
তব সে অরূপ মিলাইয়া আছে
চোখ বলে কেন কল্পনা দিয়ে
নিজেরে নিজে ভুলাই।।
চোখ বলে তুমি নাই
মিছে শুধু তোমায় ডেকে ডেকে মরি
দেখা কভু নাহি পাই।
মন বলে ঐ তৃণ-লতা-গাছে
তব সে অরূপ মিলাইয়া আছে
চোখ বলে কেন কল্পনা দিয়ে
নিজেরে নিজে ভুলাই।।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
আসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশায় নৃত্য পাগল
সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক ভেনে ভাঙলো আগল
মৃত্যুগহন অন্ধকুপে মহাকালের চন্ডরূপে ধূম্রধূপে
বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর
ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
দ্বাদশ রবির বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়নকটায়
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়
বিন্দু তাহার নয়নজলে সপ্তমহাসিন্ধু দোলে কপোলতলে
বিশ্বমায়ের আসন তারই বিপুল বাহুর পর
হাঁকে ঐ জয় প্রলয়ংকর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
মাভৈঃ মাভৈঃ জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে
জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে
এবার মহানিশার শেষে আসবে Œষা অরুণ হেসে তরুণ বেশে
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশুচাঁদের কর
আলো তার ভরবে এবার ঘর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
আসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশায় নৃত্য পাগল
সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক ভেনে ভাঙলো আগল
মৃত্যুগহন অন্ধকুপে মহাকালের চন্ডরূপে ধূম্রধূপে
বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর
ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
দ্বাদশ রবির বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়নকটায়
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়
বিন্দু তাহার নয়নজলে সপ্তমহাসিন্ধু দোলে কপোলতলে
বিশ্বমায়ের আসন তারই বিপুল বাহুর পর
হাঁকে ঐ জয় প্রলয়ংকর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
মাভৈঃ মাভৈঃ জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে
জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে
এবার মহানিশার শেষে আসবে Œষা অরুণ হেসে তরুণ বেশে
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশুচাঁদের কর
আলো তার ভরবে এবার ঘর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
চুড়ির তালে নুড়ির মালা
চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনি ঝিনি বাজে লো
খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি
কালো ছোঁড়ার কাঁকাল ধরে নাচে মাতাল ছুঁড়ি লো
খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি।
মহুয়া মদের নেশা পিয়ে, বুঁদ হয়েছে বৌয়ে-ঝিয়ে
চাঁদ ছুটছে মনকে নিয়ে যেন ডুরি ছেঁড়া ঘুড়ি লো।
বাজে নুপূর পাঁইজোড়, সারা গায়ে নাচের ঘোর
ওলো লেগেছে মন হল নেশায় বিভোর
ওই আকাশে চাঁদ হের মেঘের সাথে যেন করে খুন্সুড়ি লো।।
খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি
কালো ছোঁড়ার কাঁকাল ধরে নাচে মাতাল ছুঁড়ি লো
খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি।
মহুয়া মদের নেশা পিয়ে, বুঁদ হয়েছে বৌয়ে-ঝিয়ে
চাঁদ ছুটছে মনকে নিয়ে যেন ডুরি ছেঁড়া ঘুড়ি লো।
বাজে নুপূর পাঁইজোড়, সারা গায়ে নাচের ঘোর
ওলো লেগেছে মন হল নেশায় বিভোর
ওই আকাশে চাঁদ হের মেঘের সাথে যেন করে খুন্সুড়ি লো।।
গুঞ্জ-মালা গলে
গুঞ্জা-মালা গলে কুঞ্জে এস হে কালা
বনমালী এস দুলাইয়া বনমালা।
তব পথে বকুল ঝরিছে উতল বায়ে
দলিয়া যাবে চলি অরুণ-রাঙা পায়ে
রচেছি আসন তরুর তমাল ছায়ে
পলাশে শিমুলে রাঙা প্রদীপ জ্বালা।
ময়ুরে নাচাও এসে তোমার নূপুর তালে
বেঁধেছি ঝুলনিয়া ফুলেল্ কদম ডালে
তোমা বিনে বনমালী বিফল এ ফুল-দোল
বাঁশী বাজিবে কবে উতলা ব্রজবালা।।
বনমালী এস দুলাইয়া বনমালা।
তব পথে বকুল ঝরিছে উতল বায়ে
দলিয়া যাবে চলি অরুণ-রাঙা পায়ে
রচেছি আসন তরুর তমাল ছায়ে
পলাশে শিমুলে রাঙা প্রদীপ জ্বালা।
ময়ুরে নাচাও এসে তোমার নূপুর তালে
বেঁধেছি ঝুলনিয়া ফুলেল্ কদম ডালে
তোমা বিনে বনমালী বিফল এ ফুল-দোল
বাঁশী বাজিবে কবে উতলা ব্রজবালা।।
আমি যদি আরব হতাম
আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ
এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত।
পয়জা তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে
আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে
সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত
মা ফাতেমা খেলত এসে আমার ধূলি লয়ে
আমি পড়তাম তার পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে
হাসান হোসেন হেসে হেসে
নাচত আমার বক্ষে এসে
চক্ষে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত।
আমার বুকে পা ফেলে রে বীর আসহাব যত
রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর ক্ষত
কুল মুসলিম আসত কাবায়
চলতে পায়ে দলত আমায়
আমি চাইতাম খোদার দীদার শাফায়ত জিন্নত।।
এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত।
পয়জা তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে
আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে
সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত
মা ফাতেমা খেলত এসে আমার ধূলি লয়ে
আমি পড়তাম তার পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে
হাসান হোসেন হেসে হেসে
নাচত আমার বক্ষে এসে
চক্ষে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত।
আমার বুকে পা ফেলে রে বীর আসহাব যত
রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর ক্ষত
কুল মুসলিম আসত কাবায়
চলতে পায়ে দলত আমায়
আমি চাইতাম খোদার দীদার শাফায়ত জিন্নত।।
উম্মত আমি গুনাহগার
উম্মত আমি গুনাহগার
(সুন্ধু ভৈরবী- কার্ফা)
উম্মত আমি গুনাহগার
তবু ভয় নাহি রে আমার
আহমদ আমার নবী
যিনি খোদ হাবিব খোদার।।
যাঁহার উম্মত হতে চাহে সকল নবী,
তাহারি দামন ধরি' পুলসিরাত হব পার।।
কাঁদিবে রোজ হাশরে সবে
যবে নাফসি ইয়া নাফসি রবে,
ইয়া উম্মতী বলে একা কাঁদিবেন আমার মোখতার।।
কাঁদিবেন সাথে মা ফাতিমা ধরিয়া আরশ আল্লার
হোসায়েনের খুনের বদলায় মাফী চাই পাপী সবাকার।।
দোযখ হয়েছে হারাম যে দিন পড়েছি কালেমা,
যেদিন হয়েছি আমি কোরানের নিশান- বর্দার।।
(গুল বাগিচা)- কাজী নজরুল ইসলাম-
(সুন্ধু ভৈরবী- কার্ফা)
উম্মত আমি গুনাহগার
তবু ভয় নাহি রে আমার
আহমদ আমার নবী
যিনি খোদ হাবিব খোদার।।
যাঁহার উম্মত হতে চাহে সকল নবী,
তাহারি দামন ধরি' পুলসিরাত হব পার।।
কাঁদিবে রোজ হাশরে সবে
যবে নাফসি ইয়া নাফসি রবে,
ইয়া উম্মতী বলে একা কাঁদিবেন আমার মোখতার।।
কাঁদিবেন সাথে মা ফাতিমা ধরিয়া আরশ আল্লার
হোসায়েনের খুনের বদলায় মাফী চাই পাপী সবাকার।।
দোযখ হয়েছে হারাম যে দিন পড়েছি কালেমা,
যেদিন হয়েছি আমি কোরানের নিশান- বর্দার।।
(গুল বাগিচা)- কাজী নজরুল ইসলাম-
অনুরোধ
পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া।
যাও রে বইয়া এই গরীবের সালামখানি লইয়া।।
কাবার জিয়ারতের আমার নাই সম্বল ভাই,
সারা জনম সাধ ছিল যে, মদিনাতে যাই ( রে ভাই)।
মিটল না সাধ, দিন গেল মোর দুনিয়ার বোঝা বইয়া।।
তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি,
লইয়া যাওরে এই নিরাশের দীর্ঘ নিশ্বাসখানি।
নবীজীর রওজায় কাঁদিও ভাই রে আমার হইয়া।।
মা ফাতেমা হযরত আলীর মাজার যেথায় আছে,
আমার সালাম দিয়া আইস তাঁদের পায়ের কাছে।
কাবায় মোজানাজাত করিও আমার কথা কইয়া।।
-কাজী নজরুল ইসলাম-
যাও রে বইয়া এই গরীবের সালামখানি লইয়া।।
কাবার জিয়ারতের আমার নাই সম্বল ভাই,
সারা জনম সাধ ছিল যে, মদিনাতে যাই ( রে ভাই)।
মিটল না সাধ, দিন গেল মোর দুনিয়ার বোঝা বইয়া।।
তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি,
লইয়া যাওরে এই নিরাশের দীর্ঘ নিশ্বাসখানি।
নবীজীর রওজায় কাঁদিও ভাই রে আমার হইয়া।।
মা ফাতেমা হযরত আলীর মাজার যেথায় আছে,
আমার সালাম দিয়া আইস তাঁদের পায়ের কাছে।
কাবায় মোজানাজাত করিও আমার কথা কইয়া।।
-কাজী নজরুল ইসলাম-
তোমায় যেমন করে ডেকেছিল
তোমায় যেমন করে ডেকেছিল আরব মরুভূমি;
ওগো আমার নবী প্রিয় আল আরাবী,
তেমনি করে ডাকি যদি আসবে নাকি তুমি।।
যেমন কেঁদে দজলা ফোরাত নদী
ডেকেছিল নিরবধি,
হে মোর মরুচারী নবুয়তধারী,
তেমনি করে কাঁদি যদি আসবে নাকি তুমি।।
যেমন মদিনা আর হেরা পাহাড়
জেগেছিল আশায় তোমার
হে হযরত মম, হে মোর প্রিয়তম,
তেমনি করে জাগি যদি আসবে নাকি তুমি।।
মজলুমেরা কাবা ঘরে
কেঁদেছিল যেমন করে,
হে আমিনা- লালা, হে মোর কামলীওয়ালা,
তেমনি করে চাহি যদি আসবে নাকি তুমি।।
- কাজী নজরুল ইসলাম-
ওগো আমার নবী প্রিয় আল আরাবী,
তেমনি করে ডাকি যদি আসবে নাকি তুমি।।
যেমন কেঁদে দজলা ফোরাত নদী
ডেকেছিল নিরবধি,
হে মোর মরুচারী নবুয়তধারী,
তেমনি করে কাঁদি যদি আসবে নাকি তুমি।।
যেমন মদিনা আর হেরা পাহাড়
জেগেছিল আশায় তোমার
হে হযরত মম, হে মোর প্রিয়তম,
তেমনি করে জাগি যদি আসবে নাকি তুমি।।
মজলুমেরা কাবা ঘরে
কেঁদেছিল যেমন করে,
হে আমিনা- লালা, হে মোর কামলীওয়ালা,
তেমনি করে চাহি যদি আসবে নাকি তুমি।।
- কাজী নজরুল ইসলাম-
পাষাণের ভাঙালে ঘুম
পাষাণের ভাঙালে ঘুম
কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়
গলিয়া সুরের তুষার
গীতিনির্ঝর বয়ে যায়।
উদাসী বিবাগী মন
যাচে আজ বাহুর বাঁধন
কত জনমের কাঁদন
ও পায়ে লুটাতে চায়।
ওগো তোমার চরণ ছন্দে মোর
মুঞ্জরিল গানের মুকুল
তোমার বেণীর বন্ধে গো
মরিতে চায় সুরের বকুল।
চমকে ওঠে মোর গগণ
ঐ হরিণ চোখের চাওয়ায়।
কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়
গলিয়া সুরের তুষার
গীতিনির্ঝর বয়ে যায়।
উদাসী বিবাগী মন
যাচে আজ বাহুর বাঁধন
কত জনমের কাঁদন
ও পায়ে লুটাতে চায়।
ওগো তোমার চরণ ছন্দে মোর
মুঞ্জরিল গানের মুকুল
তোমার বেণীর বন্ধে গো
মরিতে চায় সুরের বকুল।
চমকে ওঠে মোর গগণ
ঐ হরিণ চোখের চাওয়ায়।
তোমারি আঁখির মত
তোমারি আঁখির মত আকাশের দুটি তারা
চেয়ে থাকে মোর পানে নিশীথে তন্দ্রাহারা।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
ক্ষীণ আঁখিদীপ জ্বালি বাতায়নে জাগি একা
অসীম অন্ধকারে খুঁজি তব পথরেখা
সহসা দখিনবায়ে চাঁপাবনে জাগে সাড়া।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
তব স্মৃতি যদি ভুলি ক্ষণতরে আনকাজে
কে যেন কাঁদিয়া ওঠে আমার বুকের মাঝে।
বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে
বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে
ঝড় চলে যায় কেঁদে, ঢালিয়া শ্রাবণধারা।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
চেয়ে থাকে মোর পানে নিশীথে তন্দ্রাহারা।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
ক্ষীণ আঁখিদীপ জ্বালি বাতায়নে জাগি একা
অসীম অন্ধকারে খুঁজি তব পথরেখা
সহসা দখিনবায়ে চাঁপাবনে জাগে সাড়া।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
তব স্মৃতি যদি ভুলি ক্ষণতরে আনকাজে
কে যেন কাঁদিয়া ওঠে আমার বুকের মাঝে।
বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে
বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে
ঝড় চলে যায় কেঁদে, ঢালিয়া শ্রাবণধারা।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
তরুণ প্রেমিক
তরুণ প্রেমিক, প্রণয় বেদন
জানাও জানাও বে-দিল প্রিয়ায়
ওগো বিজয়ী, নিখিল হূদয়
কর কর জয় মোহন মায়ায়।
নহে ও এক হিয়ার সমান
হাজার কাবা হাজার মস্জিদ
কি হবে তোর কাবার খোঁজে
আশয় খোঁজ তোর হূদয় ছায়ায়।
প্রেমের আলোয় যে দিল্ রোশন
যেথায় থাকুক সমান তাহার
খুদার মস্জিদ মুরত মন্দির
ইশাই দেউল ইহুদখানায়।
অমর তার নাম প্রেমের খাতায়
জ্যোতির লেখায় রবে লেখা
দোজখের ভয় করে না সে
থাকে না সে বেহেস্তের আশায়।।
জানাও জানাও বে-দিল প্রিয়ায়
ওগো বিজয়ী, নিখিল হূদয়
কর কর জয় মোহন মায়ায়।
নহে ও এক হিয়ার সমান
হাজার কাবা হাজার মস্জিদ
কি হবে তোর কাবার খোঁজে
আশয় খোঁজ তোর হূদয় ছায়ায়।
প্রেমের আলোয় যে দিল্ রোশন
যেথায় থাকুক সমান তাহার
খুদার মস্জিদ মুরত মন্দির
ইশাই দেউল ইহুদখানায়।
অমর তার নাম প্রেমের খাতায়
জ্যোতির লেখায় রবে লেখা
দোজখের ভয় করে না সে
থাকে না সে বেহেস্তের আশায়।।
চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়
আরবী (নৃত্যের) সুর - কার্ফা
চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়
পল্লী-বালিকা বন-পথে যায়
একেলা বন-পথে যায়।
সাড়ি তার কাঁটা-লতায়
জড়িয়ে জড়িয়ে যায়
পাগল হাওয়াতে অঞ্চল লয়ে মাতে
যেন তার তনুর পরশ চায়।
একেলা বনপথে যায়।
শিরীষের পাতায় নূপুর
বাজে তার ঝুমুর ঝুমুর
কুসুম ঝরিয়া মরিতে
চাহে তার কবরীতে,
পাখী গায় পাতার ঝরোকায়।
একেলা বনপথে যায়।
চাহি তার নীল নয়নে
হরিণী লুকায় বনে,
হাতে তার কাঁকন হতে
মাধবী লতা কাঁদে
ভ্রমরা কুন্তলে লুকায়।
একেলা বনপথে যায়।।
চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়
পল্লী-বালিকা বন-পথে যায়
একেলা বন-পথে যায়।
সাড়ি তার কাঁটা-লতায়
জড়িয়ে জড়িয়ে যায়
পাগল হাওয়াতে অঞ্চল লয়ে মাতে
যেন তার তনুর পরশ চায়।
একেলা বনপথে যায়।
শিরীষের পাতায় নূপুর
বাজে তার ঝুমুর ঝুমুর
কুসুম ঝরিয়া মরিতে
চাহে তার কবরীতে,
পাখী গায় পাতার ঝরোকায়।
একেলা বনপথে যায়।
চাহি তার নীল নয়নে
হরিণী লুকায় বনে,
হাতে তার কাঁকন হতে
মাধবী লতা কাঁদে
ভ্রমরা কুন্তলে লুকায়।
একেলা বনপথে যায়।।
এসো প্রিয় আরো কাছে
দেশী টোড়ি, ত্রিতাল
এস প্রিয় আরো কাছে
পাইতে হূদয়ে যে বিরহী মন যাচে।
দেখাও প্রিয়-ঘন স্বরূপ মোহন
যে রূপে প্রেমাবেশে পরাণ নাচে।।
এস প্রিয় আরো কাছে
পাইতে হূদয়ে যে বিরহী মন যাচে।
দেখাও প্রিয়-ঘন স্বরূপ মোহন
যে রূপে প্রেমাবেশে পরাণ নাচে।।
আমরা সেই সে জাতি
ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি।
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।
আমরা সেই সে জাতি।।
পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা
মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙ্গাড়ি শীতল শান্তিধারা,
উচ্চ- নীচের ভেদ ভাঙ্গি দিল সবারে বক্ষ পাতি।
আমরা সেই সে জাতি।।
কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি ক ইসলাম
সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম।
আমির- ফকিরে ভেদ নাই সবে সব ভাই এক সাথী
আমরা সেই সে জাতি।।
নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার
মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার,
আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি।
আমরা সেই সে জাতি।।
-কাজী নজরুল ইসলাম-
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।
আমরা সেই সে জাতি।।
পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা
মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙ্গাড়ি শীতল শান্তিধারা,
উচ্চ- নীচের ভেদ ভাঙ্গি দিল সবারে বক্ষ পাতি।
আমরা সেই সে জাতি।।
কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি ক ইসলাম
সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম।
আমির- ফকিরে ভেদ নাই সবে সব ভাই এক সাথী
আমরা সেই সে জাতি।।
নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার
মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার,
আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি।
আমরা সেই সে জাতি।।
-কাজী নজরুল ইসলাম-
এস হে সজল
এস হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া
বেণুকুঞ্জ ছায়ায় এস
তাল তমাল বনে এস শ্যামল
ফুটাইয়া যূঁথী-কুন্দ-নীপ-কেয়া।
বারিধারে এস চারিধার ভাসায়ে
বিদ্যুৎ-ইঙ্গিতে দশ দিক হাসায়ে
বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া
ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।
শ্রাবণ বরিষণ হরষণ ঘনায়ে
এস নব ঘনশ্যাম নূপুর শোনায়ে
হিজল তমাল ডালে ঝুলন ঝুলায়ে
তাপিতা ধরার চোখে অঞ্জন বুলায়ে
যমুনা স্রোতে ভাসায়ে প্রেমের খেয়া
ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।।
বেণুকুঞ্জ ছায়ায় এস
তাল তমাল বনে এস শ্যামল
ফুটাইয়া যূঁথী-কুন্দ-নীপ-কেয়া।
বারিধারে এস চারিধার ভাসায়ে
বিদ্যুৎ-ইঙ্গিতে দশ দিক হাসায়ে
বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া
ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।
শ্রাবণ বরিষণ হরষণ ঘনায়ে
এস নব ঘনশ্যাম নূপুর শোনায়ে
হিজল তমাল ডালে ঝুলন ঝুলায়ে
তাপিতা ধরার চোখে অঞ্জন বুলায়ে
যমুনা স্রোতে ভাসায়ে প্রেমের খেয়া
ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।।
ওগো প্রিয় তব গান
ওগো প্রিয় তব গান
আকাশ গাঙের জোয়ারে উজান বাহিয়া যায়।
মোর কথাগুলি কাঁদিছে বুকের মাঝারে,
পথ খুঁজে নাহি পায়।
ওগো দখিনা বাতাস, ফুলের সুরভি বহ
ওরি সাথে মোর না বলা বাণী লহ।
ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহ
বন্দিনী গিরি-ঝরণা পাষাণতলে যে কথা কহিতে চায়।
ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি
তোদের ভাটির স্রোতে
নিয়ে যা আমার না বলা কথাগুলি
ধুয়ে মোর বুক হতে।
ওরে ‘চোখ গেল’ ‘বৌ কথা কও’ পাখি
তোদের কণ্ঠে মোর সুর যাই রাখি।
ওরে মাঠের মুরলি কহিও তাহারে ডাকি
আমার এ কলি, না-ফোটা বুলি, ঝরে গেল নিরাশায়।।
আকাশ গাঙের জোয়ারে উজান বাহিয়া যায়।
মোর কথাগুলি কাঁদিছে বুকের মাঝারে,
পথ খুঁজে নাহি পায়।
ওগো দখিনা বাতাস, ফুলের সুরভি বহ
ওরি সাথে মোর না বলা বাণী লহ।
ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহ
বন্দিনী গিরি-ঝরণা পাষাণতলে যে কথা কহিতে চায়।
ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি
তোদের ভাটির স্রোতে
নিয়ে যা আমার না বলা কথাগুলি
ধুয়ে মোর বুক হতে।
ওরে ‘চোখ গেল’ ‘বৌ কথা কও’ পাখি
তোদের কণ্ঠে মোর সুর যাই রাখি।
ওরে মাঠের মুরলি কহিও তাহারে ডাকি
আমার এ কলি, না-ফোটা বুলি, ঝরে গেল নিরাশায়।।
ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান
ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান
আসিবে আজ বন্ধু মোর।
স্বপন মাখিয়া সোনার পাখায়
আকাশে উধাও চিত-চকোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
হিজল বিছানো বন পথ দিয়া
রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।
নদীর পারে বন কিনারে
ইঙ্গিত হানে শ্যাম কিশোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
চন্দ্রচূড় মেঘের গায়
মরাল-মিথুন উড়িয়া যায়,
নেশা ধরে চোখে আলো-ছায়ায়
বহিছে পবন গন্ধ চোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।
স্বপন মাখিয়া সোনার পাখায়
আকাশে উধাও চিত-চকোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
হিজল বিছানো বন পথ দিয়া
রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।
নদীর পারে বন কিনারে
ইঙ্গিত হানে শ্যাম কিশোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
চন্দ্রচূড় মেঘের গায়
মরাল-মিথুন উড়িয়া যায়,
নেশা ধরে চোখে আলো-ছায়ায়
বহিছে পবন গন্ধ চোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
জনম জনম গেলো
জনম জনম গেলো, আশা পথ চাহি,
মরু মুসাফির চলি, পার নাহি নাহি।
বরষও পরে বরষ, আসে যায় ফিরে,
পিপাসা মিটায়ে চলি, নয়নেরও তীরে,
জ্বালিয়া আলেয়া শিখা, নিরাশার মরিচীকা,
ডাকে মরু প্রাণনিকা, শত গীত গাহি।
জনম জনম গেলো, আশা পথ চাহি।
এ মরু ছিল গো কবে সাগরের বারি
স্বপনে হেরি গো তারে আজো মরুচারী
সেই সে সাগর তলে যে তরী ডুবিল জলে
সে তরী-সাথীরে খুঁজি মরুপথ বাহি
মরু মুসাফির চলি, পার নাহি নাহি।
বরষও পরে বরষ, আসে যায় ফিরে,
পিপাসা মিটায়ে চলি, নয়নেরও তীরে,
জ্বালিয়া আলেয়া শিখা, নিরাশার মরিচীকা,
ডাকে মরু প্রাণনিকা, শত গীত গাহি।
জনম জনম গেলো, আশা পথ চাহি।
এ মরু ছিল গো কবে সাগরের বারি
স্বপনে হেরি গো তারে আজো মরুচারী
সেই সে সাগর তলে যে তরী ডুবিল জলে
সে তরী-সাথীরে খুঁজি মরুপথ বাহি
Friday, 15 June 2012
মোমতাজ! মোমতাজ!
মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল
(যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম,
ফিরদৌসের একমুঠো প্রেম,
আজো করে ঝলমল।
কত সম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে
পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাহ্জাহানে
শ্বেত মর্মরে সেই বিরহীর ক্রন্দন মর্মর
গুঞ্জরে অবিরল।
কেমনে জানিল শাহ্জাহান, প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়!
(তাই) পাষাণ প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়?
(যেন) তাজের পাষাণ অঞ্জলি লয়ে নিঠুর বিধাতা পানে
অতৃপ্ত প্রেম বিরহী-আত্মা আজো অভিযোগ হানে
(বুঝি) সেই লাজে বালুকায় মুখ লুকাইতে চায়
শীর্ণা যমুনা জল।।
(যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম,
ফিরদৌসের একমুঠো প্রেম,
আজো করে ঝলমল।
কত সম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে
পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাহ্জাহানে
শ্বেত মর্মরে সেই বিরহীর ক্রন্দন মর্মর
গুঞ্জরে অবিরল।
কেমনে জানিল শাহ্জাহান, প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়!
(তাই) পাষাণ প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়?
(যেন) তাজের পাষাণ অঞ্জলি লয়ে নিঠুর বিধাতা পানে
অতৃপ্ত প্রেম বিরহী-আত্মা আজো অভিযোগ হানে
(বুঝি) সেই লাজে বালুকায় মুখ লুকাইতে চায়
শীর্ণা যমুনা জল।।
মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়
মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়
মৃণ্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা
তাই দুর্গতি ঘুচিল না হায়।
যে মহাশক্তির হয় না বিসর্জন
অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুক্ষণ
মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী
সেই দুর্গারে দেশ চায়।
আমাদের দ্বিভুজে দশভুজা শক্তি
দে পরব্রক্ষ্মময়ী
শক্তি পূজার ফল ভক্তি কি পাব শুধু
হব না কি বিশ্বজয়ী?
এ পূজা বিলাস সংহার কর
যদি পুত্র শক্তি নাহি পায়।
মৃণ্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা
তাই দুর্গতি ঘুচিল না হায়।
যে মহাশক্তির হয় না বিসর্জন
অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুক্ষণ
মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী
সেই দুর্গারে দেশ চায়।
আমাদের দ্বিভুজে দশভুজা শক্তি
দে পরব্রক্ষ্মময়ী
শক্তি পূজার ফল ভক্তি কি পাব শুধু
হব না কি বিশ্বজয়ী?
এ পূজা বিলাস সংহার কর
যদি পুত্র শক্তি নাহি পায়।
চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে
চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে
ছোটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।
হেরিছে রজনী রজনী জাগিয়া
চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া
কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া
কুমুদীরে কাঁদাইতে।
না জানি সজনী কত সে রজনী
কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া
হেরেছে শশীরে সরসী মুকুরে
ভীরু ছায়া তরু কাঁপিয়া।
কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী
চিরবিরহিণী রোহিণী ভরণী
অবশ আকাশ বিবশা ধরণী
কাঁদানীয়া চাঁদিনীতে।।
ছোটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।
হেরিছে রজনী রজনী জাগিয়া
চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া
কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া
কুমুদীরে কাঁদাইতে।
না জানি সজনী কত সে রজনী
কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া
হেরেছে শশীরে সরসী মুকুরে
ভীরু ছায়া তরু কাঁপিয়া।
কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী
চিরবিরহিণী রোহিণী ভরণী
অবশ আকাশ বিবশা ধরণী
কাঁদানীয়া চাঁদিনীতে।।
শূণ্য এ বুকে পাখি মোর আয়
শূণ্য এ বুকে পাখি মোর আয়
ফিরে আয় ফিরে আয়।
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়।
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ
পান্ডুর হলো আকাশের চাঁদ
কেঁদে নদী হলো করুণ বিষাদ
ডাকে আয় তীরে আয়।।
আকাশে মেলিয়া শত শত কর
খোঁজে তোরে তরু ওরে সুন্দর
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড়
লুটায় লতা ধূলায়।
তুই ফিরে এলে ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বন ফুল দল
ধূসর আকাশ হইবে সুনীল
তোর চোখের চাওয়ায়।।
ফিরে আয় ফিরে আয়।
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়।
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ
পান্ডুর হলো আকাশের চাঁদ
কেঁদে নদী হলো করুণ বিষাদ
ডাকে আয় তীরে আয়।।
আকাশে মেলিয়া শত শত কর
খোঁজে তোরে তরু ওরে সুন্দর
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড়
লুটায় লতা ধূলায়।
তুই ফিরে এলে ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বন ফুল দল
ধূসর আকাশ হইবে সুনীল
তোর চোখের চাওয়ায়।।
হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি
তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়
সুখের স্বরগ হইতে নামি।
চারিপাশে মোর উড়িছে কেবল
শুকনো পাতা মলিন ফুলদল
বৃথাই কেন হায় তব আঁখিজল
ছিটাও অবিরল দিবসযামী।
এলে অবেলায় পথিক বেভুল
বিঁধিছে কাঁটা নাহি যবে ফুল
কি দিয়া বরণ করি ও চরণ
নিভিছে জীবন, জীবনস্বামী।।
কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি
তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়
সুখের স্বরগ হইতে নামি।
চারিপাশে মোর উড়িছে কেবল
শুকনো পাতা মলিন ফুলদল
বৃথাই কেন হায় তব আঁখিজল
ছিটাও অবিরল দিবসযামী।
এলে অবেলায় পথিক বেভুল
বিঁধিছে কাঁটা নাহি যবে ফুল
কি দিয়া বরণ করি ও চরণ
নিভিছে জীবন, জীবনস্বামী।।
Wednesday, 13 June 2012
আমার কোন কুলে আজ
আমার কোন কুলে আজ ভিড়লো তরী
এ কোন সোনার গাঁয়?
আমার ভাটির তরী আবার কেন
উজান যেতে চায়?
দুখেরে কান্ডারী করি
আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙ্গা তরী
তুমি ডাক দিলে কি স্বপন পরী
নয়ন ইশারায় গো?
নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিলে ঝড়ের রাতি
কে এলে মোর সুরের সাথি
গানের কিনারায়?
সোনার দেশের সোনার মেয়ে
ওগো হবে কি মোর তরীর নেয়ে
এবার ভাঙ্গা তরী চল বেয়ে
রাঙা অলকায়।।
এ কোন সোনার গাঁয়?
আমার ভাটির তরী আবার কেন
উজান যেতে চায়?
দুখেরে কান্ডারী করি
আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙ্গা তরী
তুমি ডাক দিলে কি স্বপন পরী
নয়ন ইশারায় গো?
নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিলে ঝড়ের রাতি
কে এলে মোর সুরের সাথি
গানের কিনারায়?
সোনার দেশের সোনার মেয়ে
ওগো হবে কি মোর তরীর নেয়ে
এবার ভাঙ্গা তরী চল বেয়ে
রাঙা অলকায়।।
আমার হাতে কালি মুখে কালি
আমার হাতে কালি মুখে কালি
আমার কালিমাখা মুখ দেখে মা
পাড়ার লোকে হাসে খালি।
মোর লেখাপড়া হল না মা
আমি ম দেখিতেই দেখি শ্যামা।
আমি ক লিখিতেই কালী বলে
(মা) নাচি দিয়ে করতালি।
কালো আঁক দেখে মা ধারাপাতের
ধারা নামে আঁখিপাতে।
আমার বর্ণপরিচয় হল না মা
তোর বর্ণ বিনা কালী।
যা লিখিস মা বনের পাতায়
সাগর জলে আকাশ খাতায়
আমি সে লেখা তোর পড়তে পারি
(লোকে) মূর্খ বলে দিক না গালি।।
আমার কালিমাখা মুখ দেখে মা
পাড়ার লোকে হাসে খালি।
মোর লেখাপড়া হল না মা
আমি ম দেখিতেই দেখি শ্যামা।
আমি ক লিখিতেই কালী বলে
(মা) নাচি দিয়ে করতালি।
কালো আঁক দেখে মা ধারাপাতের
ধারা নামে আঁখিপাতে।
আমার বর্ণপরিচয় হল না মা
তোর বর্ণ বিনা কালী।
যা লিখিস মা বনের পাতায়
সাগর জলে আকাশ খাতায়
আমি সে লেখা তোর পড়তে পারি
(লোকে) মূর্খ বলে দিক না গালি।।
আমি যার নূপুরের ছন্দ
আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর
কে সেই সুন্দর, কে?
আমি যার বিলাস যমুনা, বিরহ বিধুর
কে সেই সুন্দর, কে?
যাহার গলে আমি বনমালা
আমি যার কথার কুসুমডালা
না দেখা সুদূর
কে সেই সুন্দর, কে?
যার শিখীপাখা লেখনী হয়ে
গোপনে মোরে কবিতা লেখায়
সে রহে কোথায় হায়?
আমি যার বরষার আনন্দ কেকা
নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনীরেখা
যে মম অঙ্গের কাঁকন-কেয়ূর
কে সেই সুন্দর, কে?
কে সেই সুন্দর, কে?
আমি যার বিলাস যমুনা, বিরহ বিধুর
কে সেই সুন্দর, কে?
যাহার গলে আমি বনমালা
আমি যার কথার কুসুমডালা
না দেখা সুদূর
কে সেই সুন্দর, কে?
যার শিখীপাখা লেখনী হয়ে
গোপনে মোরে কবিতা লেখায়
সে রহে কোথায় হায়?
আমি যার বরষার আনন্দ কেকা
নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনীরেখা
যে মম অঙ্গের কাঁকন-কেয়ূর
কে সেই সুন্দর, কে?
আন্মনে জল নিতে
আন্মনে জল নিতে ভাসিল গাগরী
সাঁতার জানি না, আনি কলস কেমন করি।
জানি না বলিব কি, শুধাবে যবে ননদী
কাহার কথা ভাবে পোড়া মন নিরবধি
গাগরী না ভাসিয়া ভাসিতাম আমি যদি-
কি বলিব কেন মোর ভিজিল গো ঘাগরী
একেলা কুলবধূ, পথ বিজন, নদীর বাঁকে
ডাকিল বৌ-কথা-কও কেন হলুদ চাঁপার শাখে
বিদেশে শ্যাম আমার, পড়ল মনে সেই ডাকে
ঠাঁই দে যমুনে বুকে, আমিও ডুবিয়া মরি।।
সাঁতার জানি না, আনি কলস কেমন করি।
জানি না বলিব কি, শুধাবে যবে ননদী
কাহার কথা ভাবে পোড়া মন নিরবধি
গাগরী না ভাসিয়া ভাসিতাম আমি যদি-
কি বলিব কেন মোর ভিজিল গো ঘাগরী
একেলা কুলবধূ, পথ বিজন, নদীর বাঁকে
ডাকিল বৌ-কথা-কও কেন হলুদ চাঁপার শাখে
বিদেশে শ্যাম আমার, পড়ল মনে সেই ডাকে
ঠাঁই দে যমুনে বুকে, আমিও ডুবিয়া মরি।।
অনেক ছিল বলার
অনেক ছিল বলার, যদি সেদিন ভালোবাসতে
পথ ছিল গো চলার, যদি দুদিন আগে আসতে
আজকে মহাসাগর স্রোতে চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা, সেই আঁধারে ভাসতে
যাই সেই আঁধারে ভাসতে।
গহন রাতি ডাকে আমায়, এসে তুমি আজকে
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার বিদায় বেলার সাঁঝকে
আসতে যদি হে অতিথি, ছিল যখন শুক্লা তিথি
ফুটতো চাঁপা, সেদিন যদি চৈতালী চাঁদ হাসতে।।
পথ ছিল গো চলার, যদি দুদিন আগে আসতে
আজকে মহাসাগর স্রোতে চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা, সেই আঁধারে ভাসতে
যাই সেই আঁধারে ভাসতে।
গহন রাতি ডাকে আমায়, এসে তুমি আজকে
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার বিদায় বেলার সাঁঝকে
আসতে যদি হে অতিথি, ছিল যখন শুক্লা তিথি
ফুটতো চাঁপা, সেদিন যদি চৈতালী চাঁদ হাসতে।।
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারনি
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারনি
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে
আমি গান গাহি আপনার দুখে
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে
আলেয়ার মত ডাকিও না আর
নিশিথ অন্ধকারে
দোয়া কর, মোরে দোয়া কর
আর আমারে লইয়া খেলোনা নিঠুর খেলা
শত কাঁদিলেঅ ফিরিবেনা
সেই শুভ লগনের বেলা
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি
তব চোখে কেন সজল মিনতী
আমি কি কোনদিন এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে
আমি গান গাহি আপনার দুখে
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে
আলেয়ার মত ডাকিও না আর
নিশিথ অন্ধকারে
দোয়া কর, মোরে দোয়া কর
আর আমারে লইয়া খেলোনা নিঠুর খেলা
শত কাঁদিলেঅ ফিরিবেনা
সেই শুভ লগনের বেলা
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি
তব চোখে কেন সজল মিনতী
আমি কি কোনদিন এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে
গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায়
গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায়
কে যেন আমারে ডাকে
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
সে কি তুমি?
কার স্মৃতি বুকে পাষানের মত ভার হয়ে যে থাকে
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন হায়
ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায়
কার সকরুন আঁখি দুটি যেন রাতের মত
মুখপানে চেয়ে থাকে
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
নিশির বাতাশ কাহার হুতাশ দীর্ঘ নিশাস সম
ঝড় তোলে এসে অন্তরে মোর
ওগো দুরন্ত মম
সে কি তুমি, সে কি তুমি
মহাসাগরের ঢেউ এর মতন
বুকে এসে বাজে কাহার রোদন
পিয়া পিয়া নাম ডাকে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি
আমার চম্পা- শাঁখে
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
কে যেন আমারে ডাকে
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
সে কি তুমি?
কার স্মৃতি বুকে পাষানের মত ভার হয়ে যে থাকে
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন হায়
ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায়
কার সকরুন আঁখি দুটি যেন রাতের মত
মুখপানে চেয়ে থাকে
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
নিশির বাতাশ কাহার হুতাশ দীর্ঘ নিশাস সম
ঝড় তোলে এসে অন্তরে মোর
ওগো দুরন্ত মম
সে কি তুমি, সে কি তুমি
মহাসাগরের ঢেউ এর মতন
বুকে এসে বাজে কাহার রোদন
পিয়া পিয়া নাম ডাকে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি
আমার চম্পা- শাঁখে
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
Sunday, 10 June 2012
আজি মনে মনে লাগে হোরী
আজি মনে মনে লাগে হোরী
আজি বনে বনে জাগে হোরী।।
ঝাঁঝর করতাল খরতালে বাজে
বাজে কংকন চুড়ি মৃদুল আওয়াজে
লচকিয়া আসে মুচকিয়া হাসে
প্রেম-উল্লাসে শ্যামল গৌরী।।
আজি কদম্ব তমাল রঙ্গে লালে লাল
হলো কৃষ্ণ ভ্রমর ভ্রমরী
রঙ্গের উজান চলে কালো যমুনার জলে
আবীর রাঙ্গা হলো ময়ূর-ময়ূরী।।
মোর হৃদি বৃন্দাবন যেন রাঙে
রাধা শ্যাম যুগল চরণ রাগে
ও চরণ ধূলি যেন ফাগ হ’য়ে মেশে রে
অন্তরে পড়ে মোর ঝরি’।।
আজি বনে বনে জাগে হোরী।।
ঝাঁঝর করতাল খরতালে বাজে
বাজে কংকন চুড়ি মৃদুল আওয়াজে
লচকিয়া আসে মুচকিয়া হাসে
প্রেম-উল্লাসে শ্যামল গৌরী।।
আজি কদম্ব তমাল রঙ্গে লালে লাল
হলো কৃষ্ণ ভ্রমর ভ্রমরী
রঙ্গের উজান চলে কালো যমুনার জলে
আবীর রাঙ্গা হলো ময়ূর-ময়ূরী।।
মোর হৃদি বৃন্দাবন যেন রাঙে
রাধা শ্যাম যুগল চরণ রাগে
ও চরণ ধূলি যেন ফাগ হ’য়ে মেশে রে
অন্তরে পড়ে মোর ঝরি’।।
Saturday, 9 June 2012
মদির স্বপনে মম মন ভবনে জাগো
মদির স্বপনে মম মন ভবনে জাগো
চঞ্চলা বাসন্তিকা, ওগো ক্ষনিকা
ওগো ক্ষনিকা।।
মোর গগনের ঊল্কার প্রায়
চমকি ক্ষনেক চকিতে মিলায়
তোমার হাসির যুঁই কনিকা
ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা।।
পুষ্পধনু তব মন রাঙ্গানো
বঙ্কিম ভুরু হানো হানো
তোমার উতল উত্তরীয়
আমারো চোখে প্রিয় ছুঁইয়ে দিও
যৌবনের দাও রাজ- টীকা
ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা
আমি হবো ওগো আমি হবো
তোমার মালার মলিকা
ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা
চঞ্চলা বাসন্তিকা, ওগো ক্ষনিকা
ওগো ক্ষনিকা।।
মোর গগনের ঊল্কার প্রায়
চমকি ক্ষনেক চকিতে মিলায়
তোমার হাসির যুঁই কনিকা
ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা।।
পুষ্পধনু তব মন রাঙ্গানো
বঙ্কিম ভুরু হানো হানো
তোমার উতল উত্তরীয়
আমারো চোখে প্রিয় ছুঁইয়ে দিও
যৌবনের দাও রাজ- টীকা
ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা
আমি হবো ওগো আমি হবো
তোমার মালার মলিকা
ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা
Sunday, 27 May 2012
‘বিদ্রোহী’ কবিতার নব্বই বছর
হোসেন মাহমুদ
http://www.amardeshonline.com/pages/weekly_news/2012/05/27/7711
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে দাপুটে কবিতা হিসেবে নিজের শীর্ষ আসনটি ধরে রেখেছে প্রায় একশ’ বছর ধরে। এ সুদীর্ঘ সময়ে এর সমপর্যায়ের বা কাছাকাছি আর কোনো কবিতা রচিত হয়নি। এ অসাধারণ কবিতাটি শুধু যে নজরুলের শ্রেষ্ঠতম কবিতা তাই নয়, কেউ কেউ এটিকে বাংলা ভাষারও শ্রেষ্ঠতম কবিতা বলে মনে করে থাকেন। কেউ কেউ বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ গোটা বিশ্বেরই একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।
বাংলা ভাষার সর্বাধিক আলোচিত ও পঠিত সাড়াজাগানো এ কবিতাটি নজরুল রচনা করেন বিশের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে, সৈনিক জীবন অবসানের পর। একটি বিব্রতকর বিষয় হচ্ছে এই যে, তাঁর আর কোনো কবিতার ক্ষেত্রে যা হয়নি, এ কবিতাটির ক্ষেত্রে সেটি হয়েছে, অর্থাত্ এ কবিতাটির প্রকাশকাল নিয়ে একটু জটিলতা রয়েছে। আগ্রহী পাঠক সহজেই জানতে পারেন, নজরুল এ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, বাংলা ১৩২৮ সনের পৌষ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ। কিন্তু কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক, ১৩২৮ সংখ্যায়। অন্যদিকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি, বাংলা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় এ কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের কথা উল্লেখ করে পুনর্মুদ্রণ করা হয়। পাঠকরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম পাঠ করলেন ‘বিজলী’ পত্রিকায়। অথচ ইতিহাস বলে, এটি প্রথম ছাপতে হয়েছিল ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়। এর কারণ কী?
এ জটিলতা সৃষ্টির কারণ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মুজফ্ফর আহমদ। তিনি ছিলেন নজরুলের প্রথম যৌবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরবর্তীকালে তিনি ভারতের শীর্ষস্থানীয় কম্যুনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদে পরিণত হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে সৈনিক জীবনের অবসান হলে নজরুল কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে বাস করতে থাকেন। মুজফ্ফর আহমদ তখন ছিলেন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সহকারী সম্পাদক। অন্যান্য কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমিতির মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র বিভিন্ন দায়িত্বও পালন করতেন, যার মধ্যে লেখা সম্পাদনার কাজও ছিল। নজরুল এ পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি এ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে মতামত লিখে পাঠাতেন। এভাবেই ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। এ সম্পর্ক পরে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মুজফ্ফর আহমদ বয়সে নজরুলের চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয়নি। বাঙালি পল্টন ভেঙে যাওয়ার পর তাঁর পরামর্শক্রমেই নজরুল কলকাতায় এসে ৩২, কলেজ স্ট্রিটে দু’জনে একই কক্ষে থাকতে শুরু করেন। পরে আরও কয়েকবার বাসা বদলের পর সর্বশেষ তাঁরা ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে এক কক্ষে থাকেন। এখানেই ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ দিকের এক রাতে নজরুল রচনা করেন তাঁর সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এ বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন :
“সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রিতে কোন সময়ে তা আমি জানি নে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি, এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”
তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন পেন্সিলে। উল্লেখ্য, সেকালে ফাউন্টেন পেন বা ঝরনা কলম ছিল না। দোয়াতের কালিতে বারবার কলম চুবিয়ে লিখতে হতো। তাঁর মাথার সঙ্গে কলম তাল মেলাতে পারবে না, এটা বুঝেই তিনি পেন্সিলে কবিতাটি লিখেছিলেন।এরপর ‘বিদ্রোহী’র প্রকাশকাল প্রসঙ্গ। কবিতাটি মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রথম নিয়ে যান আফজাল-উল-হক। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বাবা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের (নদীয়া শান্তিপুরের কবি) নাম ছাপা হলেও সব কাজ আফজাল-উল-হকই সম্পন্ন করতেন। এর পরে সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকার অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য এসে নজরুলের কাছে কবিতাটি শোনেন। তিনিও তাঁর পত্রিকার জন্য কবিতাটির একটি কপি করিয়ে নেন। এরপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি, ২২ পৌষ ১৩২৮ সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তে ‘বিদ্রোহী’ প্রথম প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে আফজাল-উল-হক যে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রথম ‘বিদ্রোহী’ নিলেন, তখন পত্রিকার কার্তিক, ১৩২৮ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। এ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় আরও তিন মাস পর ফাল্গুন, ১৩২৮-এ। যেহেতু কার্তিক, ১৩২৮ সংখ্যার ‘মোসলেম ভারতে’ ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হলো, সে কারণে সময়ের বিচারে ‘মোসলেম ভারতে’ই ‘বিদ্রোহী’ প্রথম প্রকাশিত হয় বলে ধরা হয়।এ বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন :
“সামান্য কিছু বেলা হতে ‘মোসলেম ভারতে’র আফজালুল হক সাহেব আমাদের বাড়িতে এলেন। নজরুল তাঁকেও কবিতাটি পড়ে শোনাল। তিনি তা শুনে খুব হইচই শুরু করে দিলেন। আর বললেন, ‘এখনই কপি করে দিন কবিতাটি, আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।’ পরম ধৈর্যের সহিত কবিতাটি কপি করে নজরুল তা আফজাল সাহেবকে দিল। তিনি এই কপিটি নিয়ে চলে গেলেন। আফজালুল হক সাহেব চলে যাওয়ার পর আমিও বাইরে চলে যাই। তার পরে বাড়িতে ফিরে আসি ১২টার কিছু আগে। আসামাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, ‘অবিনাশদা (বারীন ঘোষদের বোমার মামলার সহবন্দী শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, ‘বিজলী’তে ছেপে দিই আগে।’ তাঁকেও নজরুল... কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল। ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি (মুতাবিক ২২ শে পৌষ, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে, শুক্রবারে ‘বিদ্রোহী’ ‘বিজলী’তেই প্রথম ছাপা হয়েছিল।... অনেকে যে লিখেছেন ‘বিদ্রোহী’ ‘মোসলেম ভারতে’ ছাপা হয়েছিল সেটা ভুল। ‘বিদ্রোহী’ প্রথম ছাপানোর সম্মান সাপ্তাহিক ‘বিজলী’রই প্রাপ্য।”
প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ও লেখক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘নজরুল জীবনী’ গ্রন্থে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন :
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের (কলকাতা) বাড়ির নিচের তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে বসে নজরুল একরাত্রে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেন।... সকালবেলা ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সাহেব এলেন, কবিতাটি শুনে তিনি খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন এবং ‘মোসলেম ভারতের’ জন্য কবিতাটি তখনই কপি করিয়ে নিলেন। নজরুল কবিতাটি প্রথম ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকাতেই ছাপতে দিলেন। এরপর এলেন ‘বিজলী’ পত্রিকার শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি কবিতাটি শুনে ‘মোসলেম ভারত’ প্রকাশের অনিশ্চয়তা বিধায় ‘বিজলী’তে ‘বিদ্রোহী’ ছেপে দিতে চাইলেন। নজরুল যথারীতি ‘বিজলী’র জন্যেও ‘বিদ্রোহী’র সেই পেন্সিলে লেখা কপি থেকে আরেকটি কপি করে নিলেন। বস্তুতঃ ‘মোসলেম ভারতের’ প্রকাশ ইতিমধ্যেই অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল এবং ‘মোসলেম ভারতে’র আফজালুল হক ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের জন্যে প্রথমে পেলেও সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তেই কবিতাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি, মোতাবেক ২২শে পৌষ, ১৩২৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে আফজালুল হক সাহেব কার্তিক সংখ্যা ‘মোসলেম ভারতের’ জন্য পৌষ মাসে ‘বিদ্রোহী’ ছাপতে নিয়েছিলেন, আর সে সংখ্যাটি ফাল্গুন মাসের আগে প্রকাশিত হয়নি।
এখানে বলা দরকার, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তেই ‘বিদ্রোহী’ প্রথম প্রকাশিত হলেও যেহেতু নজরুল কবিতাটি প্রথমে ‘মোসলেম ভারত’-এর কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশের জন্য আফজাল-উল-হককে দিয়েছিলেন, সে কারণে ‘মোসলেম ভারত’ কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশের কথা উল্লেখ করেই ‘বিজলী’তে তা ছাপা হয়েছিল। ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মোসলেম ভারতের’ কার্তিক সংখ্যার (ফাল্গুন মাসে প্রকাশিত) সমালোচনার ছলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ‘বিজলী’তে পৌষ মাসে নিম্নোক্ত রূপে কৌশলে ছাপা হয় :
‘মোসলেম ভারত’ কার্তিক, ১৩২৮। সম্পাদক মোজাম্মেল হক। ‘মোসলেম ভারতে’র একটি বিশিষ্টতা এই যে, এতে বাজে জিনিস বড় একটা থাকে না। আমাদের বিশ্বাস, ভালো প্রবন্ধাদি সংগ্রহের জন্যই ‘মোসলেম ভারত’ ঠিক যথাসময়ে বের হয় না। এবারের ‘মোসলেম ভারতে’ শ্রীযুক্ত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের ‘চুরাশি লাখ’ সুন্দর নিবন্ধ। মোহাম্মদ লুতফর রহমানের ‘রাজনৈতিক অপরাধী’ সুন্দর তেজঃপূর্ণ প্রবন্ধ।
‘কামাল পাশা’ হাবিলদার কাজি নজরুল ইসলামের কবিতা।... ‘বিদ্রোহী’ কাজি সাহেবের আরেকটি কবিতা। কবিতাটি এত সুন্দর হয়েছে যে আমাদের স্থানাভাব হলেও তা ‘বিজলী’র পাঠক-পাঠিকাদের উপহার দেবার লোভ আমরা সম্বরণ করতে পারলাম না। (সম্পাদক, ‘বিজলী’; ২২শে পৌষ, ১৩২৮)।
উল্লেখ্য, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর ‘বিজলী’র ওই সংখ্যার সব কপি অতি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ফলে, পাঠকদের চাহিদা মেটাতে ওই সপ্তাহেই পত্রিকাটি আবার ছাপতে হয়। মুজফ্ফর আহমদ বলেন, ‘বিজলী’র ওই সংখ্যা দু’দফায় ২৯ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। তাঁর মতে, দেড় থেকে দু’ লাখের মতো লোক ওই সময় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পাঠ করেছিল। আজকার দিনে এটা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
কলকাতার পত্র-পত্রিকায় নজরুলের লেখা প্রকাশিত হতে থাকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ, ১৩২৬ বঙ্গাব্দ থেকে। ওই বছর বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর মোট দশটি লেখা প্রকাশিত হয়। এগুলো ছিল গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। এসব লেখার মধ্য দিয়ে তিনি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। পরবর্তী বছর অর্থাত্ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর (বৈশাখ, ১৩২৭ থেকে অগ্রহায়ণ ১৩২৮) পর্যন্ত একের পর এক তাঁর সেরা কবিতাগুলো, যেমন—‘শাত-ইল-আরব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’, ‘আনোয়ার’, ‘ভাঙার গান’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। এগুলো নজরুলের জন্য কবিস্বীকৃতি ও বিপুল প্রশংসা বয়ে আনে। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রকাশ সবকিছুকে যেন রাতারাতি পাল্টে দেয়। এটি কাব্যামোদী মহলে যেমন বিপুল চমকের সৃষ্টি করে, তেমনি আলোড়িত করে বাংলার তরুণ ও যুবসমাজকে। তিনি আখ্যায়িত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায়, যা পরবর্তীকালে তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
যাহোক, কাগজ-কলমের হিসাবে ‘বিদ্রোহী’র প্রথম প্রকাশের সময় কার্তিক, ১৩২৮ হলেও বাস্তবে তার প্রথম প্রকাশ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি ‘বিদ্রোহী’র প্রকাশের নব্বই বছর পূর্তি হয়েছে। বলা বাহুল্য যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পরে নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর, কার্তিক ১৩২৯ বঙ্গাব্দে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অসংখ্যবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা যেমন নজরুলকে আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দেয়, তেমনি বেশকিছু শত্রুও তৈরি করে। সৃষ্টি হয় নজরুলবিরোধী একটি গোষ্ঠী। প্রখ্যাত কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের বিরোধিতা শুরু করেন। ‘শনিবারের চিঠি’ গোষ্ঠীর নেতৃত্বদানকারী সজনী কান্ত দাস ‘বিদ্রোহী’র প্যারোডি রচনা করেন। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। হতথ্যসূত্র : কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা—মুজফ্ফর আহমদ, মুক্তধারা, ১৯৭৩২, নজরুল জীবনী—ড. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭২
http://www.amardeshonline.com/pages/weekly_news/2012/05/27/7711
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে দাপুটে কবিতা হিসেবে নিজের শীর্ষ আসনটি ধরে রেখেছে প্রায় একশ’ বছর ধরে। এ সুদীর্ঘ সময়ে এর সমপর্যায়ের বা কাছাকাছি আর কোনো কবিতা রচিত হয়নি। এ অসাধারণ কবিতাটি শুধু যে নজরুলের শ্রেষ্ঠতম কবিতা তাই নয়, কেউ কেউ এটিকে বাংলা ভাষারও শ্রেষ্ঠতম কবিতা বলে মনে করে থাকেন। কেউ কেউ বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ গোটা বিশ্বেরই একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।
বাংলা ভাষার সর্বাধিক আলোচিত ও পঠিত সাড়াজাগানো এ কবিতাটি নজরুল রচনা করেন বিশের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে, সৈনিক জীবন অবসানের পর। একটি বিব্রতকর বিষয় হচ্ছে এই যে, তাঁর আর কোনো কবিতার ক্ষেত্রে যা হয়নি, এ কবিতাটির ক্ষেত্রে সেটি হয়েছে, অর্থাত্ এ কবিতাটির প্রকাশকাল নিয়ে একটু জটিলতা রয়েছে। আগ্রহী পাঠক সহজেই জানতে পারেন, নজরুল এ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, বাংলা ১৩২৮ সনের পৌষ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ। কিন্তু কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক, ১৩২৮ সংখ্যায়। অন্যদিকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি, বাংলা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় এ কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের কথা উল্লেখ করে পুনর্মুদ্রণ করা হয়। পাঠকরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম পাঠ করলেন ‘বিজলী’ পত্রিকায়। অথচ ইতিহাস বলে, এটি প্রথম ছাপতে হয়েছিল ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়। এর কারণ কী?
এ জটিলতা সৃষ্টির কারণ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মুজফ্ফর আহমদ। তিনি ছিলেন নজরুলের প্রথম যৌবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরবর্তীকালে তিনি ভারতের শীর্ষস্থানীয় কম্যুনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদে পরিণত হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে সৈনিক জীবনের অবসান হলে নজরুল কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে বাস করতে থাকেন। মুজফ্ফর আহমদ তখন ছিলেন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সহকারী সম্পাদক। অন্যান্য কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমিতির মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র বিভিন্ন দায়িত্বও পালন করতেন, যার মধ্যে লেখা সম্পাদনার কাজও ছিল। নজরুল এ পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি এ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে মতামত লিখে পাঠাতেন। এভাবেই ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। এ সম্পর্ক পরে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মুজফ্ফর আহমদ বয়সে নজরুলের চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয়নি। বাঙালি পল্টন ভেঙে যাওয়ার পর তাঁর পরামর্শক্রমেই নজরুল কলকাতায় এসে ৩২, কলেজ স্ট্রিটে দু’জনে একই কক্ষে থাকতে শুরু করেন। পরে আরও কয়েকবার বাসা বদলের পর সর্বশেষ তাঁরা ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে এক কক্ষে থাকেন। এখানেই ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ দিকের এক রাতে নজরুল রচনা করেন তাঁর সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এ বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন :
“সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রিতে কোন সময়ে তা আমি জানি নে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি, এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”
তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন পেন্সিলে। উল্লেখ্য, সেকালে ফাউন্টেন পেন বা ঝরনা কলম ছিল না। দোয়াতের কালিতে বারবার কলম চুবিয়ে লিখতে হতো। তাঁর মাথার সঙ্গে কলম তাল মেলাতে পারবে না, এটা বুঝেই তিনি পেন্সিলে কবিতাটি লিখেছিলেন।এরপর ‘বিদ্রোহী’র প্রকাশকাল প্রসঙ্গ। কবিতাটি মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রথম নিয়ে যান আফজাল-উল-হক। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বাবা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের (নদীয়া শান্তিপুরের কবি) নাম ছাপা হলেও সব কাজ আফজাল-উল-হকই সম্পন্ন করতেন। এর পরে সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকার অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য এসে নজরুলের কাছে কবিতাটি শোনেন। তিনিও তাঁর পত্রিকার জন্য কবিতাটির একটি কপি করিয়ে নেন। এরপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি, ২২ পৌষ ১৩২৮ সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তে ‘বিদ্রোহী’ প্রথম প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে আফজাল-উল-হক যে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রথম ‘বিদ্রোহী’ নিলেন, তখন পত্রিকার কার্তিক, ১৩২৮ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। এ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় আরও তিন মাস পর ফাল্গুন, ১৩২৮-এ। যেহেতু কার্তিক, ১৩২৮ সংখ্যার ‘মোসলেম ভারতে’ ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হলো, সে কারণে সময়ের বিচারে ‘মোসলেম ভারতে’ই ‘বিদ্রোহী’ প্রথম প্রকাশিত হয় বলে ধরা হয়।এ বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন :
“সামান্য কিছু বেলা হতে ‘মোসলেম ভারতে’র আফজালুল হক সাহেব আমাদের বাড়িতে এলেন। নজরুল তাঁকেও কবিতাটি পড়ে শোনাল। তিনি তা শুনে খুব হইচই শুরু করে দিলেন। আর বললেন, ‘এখনই কপি করে দিন কবিতাটি, আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।’ পরম ধৈর্যের সহিত কবিতাটি কপি করে নজরুল তা আফজাল সাহেবকে দিল। তিনি এই কপিটি নিয়ে চলে গেলেন। আফজালুল হক সাহেব চলে যাওয়ার পর আমিও বাইরে চলে যাই। তার পরে বাড়িতে ফিরে আসি ১২টার কিছু আগে। আসামাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, ‘অবিনাশদা (বারীন ঘোষদের বোমার মামলার সহবন্দী শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, ‘বিজলী’তে ছেপে দিই আগে।’ তাঁকেও নজরুল... কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল। ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি (মুতাবিক ২২ শে পৌষ, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে, শুক্রবারে ‘বিদ্রোহী’ ‘বিজলী’তেই প্রথম ছাপা হয়েছিল।... অনেকে যে লিখেছেন ‘বিদ্রোহী’ ‘মোসলেম ভারতে’ ছাপা হয়েছিল সেটা ভুল। ‘বিদ্রোহী’ প্রথম ছাপানোর সম্মান সাপ্তাহিক ‘বিজলী’রই প্রাপ্য।”
প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ও লেখক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘নজরুল জীবনী’ গ্রন্থে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন :
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের (কলকাতা) বাড়ির নিচের তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে বসে নজরুল একরাত্রে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেন।... সকালবেলা ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সাহেব এলেন, কবিতাটি শুনে তিনি খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন এবং ‘মোসলেম ভারতের’ জন্য কবিতাটি তখনই কপি করিয়ে নিলেন। নজরুল কবিতাটি প্রথম ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকাতেই ছাপতে দিলেন। এরপর এলেন ‘বিজলী’ পত্রিকার শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি কবিতাটি শুনে ‘মোসলেম ভারত’ প্রকাশের অনিশ্চয়তা বিধায় ‘বিজলী’তে ‘বিদ্রোহী’ ছেপে দিতে চাইলেন। নজরুল যথারীতি ‘বিজলী’র জন্যেও ‘বিদ্রোহী’র সেই পেন্সিলে লেখা কপি থেকে আরেকটি কপি করে নিলেন। বস্তুতঃ ‘মোসলেম ভারতের’ প্রকাশ ইতিমধ্যেই অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল এবং ‘মোসলেম ভারতে’র আফজালুল হক ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের জন্যে প্রথমে পেলেও সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তেই কবিতাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি, মোতাবেক ২২শে পৌষ, ১৩২৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে আফজালুল হক সাহেব কার্তিক সংখ্যা ‘মোসলেম ভারতের’ জন্য পৌষ মাসে ‘বিদ্রোহী’ ছাপতে নিয়েছিলেন, আর সে সংখ্যাটি ফাল্গুন মাসের আগে প্রকাশিত হয়নি।
এখানে বলা দরকার, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তেই ‘বিদ্রোহী’ প্রথম প্রকাশিত হলেও যেহেতু নজরুল কবিতাটি প্রথমে ‘মোসলেম ভারত’-এর কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশের জন্য আফজাল-উল-হককে দিয়েছিলেন, সে কারণে ‘মোসলেম ভারত’ কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশের কথা উল্লেখ করেই ‘বিজলী’তে তা ছাপা হয়েছিল। ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মোসলেম ভারতের’ কার্তিক সংখ্যার (ফাল্গুন মাসে প্রকাশিত) সমালোচনার ছলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ‘বিজলী’তে পৌষ মাসে নিম্নোক্ত রূপে কৌশলে ছাপা হয় :
‘মোসলেম ভারত’ কার্তিক, ১৩২৮। সম্পাদক মোজাম্মেল হক। ‘মোসলেম ভারতে’র একটি বিশিষ্টতা এই যে, এতে বাজে জিনিস বড় একটা থাকে না। আমাদের বিশ্বাস, ভালো প্রবন্ধাদি সংগ্রহের জন্যই ‘মোসলেম ভারত’ ঠিক যথাসময়ে বের হয় না। এবারের ‘মোসলেম ভারতে’ শ্রীযুক্ত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের ‘চুরাশি লাখ’ সুন্দর নিবন্ধ। মোহাম্মদ লুতফর রহমানের ‘রাজনৈতিক অপরাধী’ সুন্দর তেজঃপূর্ণ প্রবন্ধ।
‘কামাল পাশা’ হাবিলদার কাজি নজরুল ইসলামের কবিতা।... ‘বিদ্রোহী’ কাজি সাহেবের আরেকটি কবিতা। কবিতাটি এত সুন্দর হয়েছে যে আমাদের স্থানাভাব হলেও তা ‘বিজলী’র পাঠক-পাঠিকাদের উপহার দেবার লোভ আমরা সম্বরণ করতে পারলাম না। (সম্পাদক, ‘বিজলী’; ২২শে পৌষ, ১৩২৮)।
উল্লেখ্য, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর ‘বিজলী’র ওই সংখ্যার সব কপি অতি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ফলে, পাঠকদের চাহিদা মেটাতে ওই সপ্তাহেই পত্রিকাটি আবার ছাপতে হয়। মুজফ্ফর আহমদ বলেন, ‘বিজলী’র ওই সংখ্যা দু’দফায় ২৯ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। তাঁর মতে, দেড় থেকে দু’ লাখের মতো লোক ওই সময় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পাঠ করেছিল। আজকার দিনে এটা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
কলকাতার পত্র-পত্রিকায় নজরুলের লেখা প্রকাশিত হতে থাকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ, ১৩২৬ বঙ্গাব্দ থেকে। ওই বছর বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর মোট দশটি লেখা প্রকাশিত হয়। এগুলো ছিল গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। এসব লেখার মধ্য দিয়ে তিনি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। পরবর্তী বছর অর্থাত্ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর (বৈশাখ, ১৩২৭ থেকে অগ্রহায়ণ ১৩২৮) পর্যন্ত একের পর এক তাঁর সেরা কবিতাগুলো, যেমন—‘শাত-ইল-আরব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’, ‘আনোয়ার’, ‘ভাঙার গান’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। এগুলো নজরুলের জন্য কবিস্বীকৃতি ও বিপুল প্রশংসা বয়ে আনে। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রকাশ সবকিছুকে যেন রাতারাতি পাল্টে দেয়। এটি কাব্যামোদী মহলে যেমন বিপুল চমকের সৃষ্টি করে, তেমনি আলোড়িত করে বাংলার তরুণ ও যুবসমাজকে। তিনি আখ্যায়িত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায়, যা পরবর্তীকালে তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
যাহোক, কাগজ-কলমের হিসাবে ‘বিদ্রোহী’র প্রথম প্রকাশের সময় কার্তিক, ১৩২৮ হলেও বাস্তবে তার প্রথম প্রকাশ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি ‘বিদ্রোহী’র প্রকাশের নব্বই বছর পূর্তি হয়েছে। বলা বাহুল্য যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পরে নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর, কার্তিক ১৩২৯ বঙ্গাব্দে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অসংখ্যবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা যেমন নজরুলকে আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দেয়, তেমনি বেশকিছু শত্রুও তৈরি করে। সৃষ্টি হয় নজরুলবিরোধী একটি গোষ্ঠী। প্রখ্যাত কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের বিরোধিতা শুরু করেন। ‘শনিবারের চিঠি’ গোষ্ঠীর নেতৃত্বদানকারী সজনী কান্ত দাস ‘বিদ্রোহী’র প্যারোডি রচনা করেন। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। হতথ্যসূত্র : কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা—মুজফ্ফর আহমদ, মুক্তধারা, ১৯৭৩২, নজরুল জীবনী—ড. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭২
Friday, 25 May 2012
আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী
বছর ঘুরে আবারো ফিরে এলো ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২৫শে মে। আজ দুখুমিয়া তথা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী। শুভ জন্মদিন হে বিদ্রোহী কবি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তোমায়।
সময় সল্পতার দরুন এবছর মনের মত করে সাজিয়ে দুখুমিয়াকে নিয়ে তেমন কিছু লিখতে পারিনি। আশা করছি গত বছর দুখুমিয়ার ১১২তম জন্মবার্ষিকী নিয়ে লেখা আমার অনুভুতির পোস্টটা পড়ে দেখবেন। সেটা পড়তে এখানে ক্লিক করেন আজ দুখু মিয়ার ১১২তম জন্মবার্ষিকী
তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ব্লগ থেকে নজরুলকে নিয়ে লেখা নজরুল ভক্তদের কিছু পোস্ট যোগ করে দিলাম। সামহোয়ার ইন ব্লগ আর সোনার বাংলা ব্লগে ব্লগারদের অনেক পোস্ট চোখে পড়েছে তন্মধ্যে কয়েকটা এখানে দেয়া হলো।
আমার দেশঃ ঢাকায় নজরুলের স্মৃতি
প্রিয়-কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সঙ্কলন
সোনার বাংলাদেশ ব্লগের ব্লগার হাসানের স্টিকি পোস্ট; "নজরুল- অন্যরকম এক শক্তি ও প্রেরণার নাম : কবির প্রতি অবহেলায় কবরের নিরবতাও যেন লজ্জা পায়!
প্রথম আলোতে সানি লিওনদের জায়গা হলেও ঠাঁই হলোনা নজরুলের! দুখু মিয়া দুঃখ পেওনা, তুমি আছ সকলের হৃদয়ে
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৩তম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলী
হূদয়ে গাঁথা নজরূল - (ছবি ব্লগ ) ১১৩ মত জন্মদিবস স্বরনে
আজ বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত তথা সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ কবি নজরুল ইসলাম এর জন্ম বার্ষিকী...
যেন কানে শুনি সদা তোমারি কালাম হে খোদা চোখে যেন দেখি শুধু কোরআনের আয়াত।
আলগা করো খোপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গেয়ি: শুভ জন্মদিন দুখু মিয়া !!
জাতীয় কবির ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে- কবির বৈচিত্রময় কান্ড কারখানা ও হাসিকান্নার ঘটনা নিয়ে দীর্ঘতম পোস্ট- অচেনা রূপে কাজী নজরুল
জন্মদিনে কিছু কথা প্রিয় কবিকে নিয়ে
কেও বলে হিন্দু তারে কেও বলে মুসলমান ভুলে যায় মানুষ সে নজরুল তার নাম। কিছু কথা তাকে নিয়ে
নজরুল তুমি এ ধরনীতে অবহেলিতই হলে, হয়ত তুমি বাংলাদেশের জাতীয় কবি বলে........
এক হাতে মম বাঁশের বাঁশরী
শ্রদ্ধাঞ্জলি.........
মনে আছে নজরুলের কবিতা লিচু চোর
মোহাম্মদ রাফির গলায় নজরুল সঙ্গীত,
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই (নজরুল)
"হিন্দু না মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন.............!"
আমার পড়া নজরুলের কিছু প্রিয় কবিতা।
হে কবি তুমি কি শুনতে পাও?
প্রিয় কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম সিরিজ -১
নজরুল ও বঙ্গবন্ধু সমান্তরালে: প্রধানমন্ত্রী
আজ কাজী নজরুল ইসলামের 124তম জন্মদিন (ব্লগারের ভুল) (
শুভ জন্মদিন, কবি।
রেজওয়ান তানিমের প্রথম আলো ব্লগ-চেতনায় নজরুল : প্রেম, দ্রোহ এবং নজরুল সাহিত্য
Wednesday, 23 May 2012
‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন ‘অজর অমর`
‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন ‘অজর অমর’:আহমদ বাসির
আর কোন্ মোহন বাঁশিতে ফুঁক দেয়া বাকি ছিল তাঁর? আর কোন্ কথা বলা বাকি ছিল তাঁর? হয়তো অনেক কথাই বলা হয়নি তাঁর! হয়তো অনেক বাঁশিই ছোঁয়া হয়নি তাঁর! তবু যত সুরে তিনি বাজিয়েছেন তাঁর অন্তরের আকাঙ্ক্ষা, যত উচ্চারণে উচ্চকিত করেছেন নিজ-সত্তাকে—তার কতটুকুই বা ধরতে পেরেছে আজও এই বৃহত্ বঙ্গের মানুষ। তার রুদ্র-রূপ আমাদের এই মহা-ক্ষুদ্রতাকে আজও অবিরাম লজ্জা দিয়ে যায়। কোথায় সে বীর, যার শির দেখে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া নত হয়ে গেল!
চির যৌবনের কবি, চির তারুণ্যের কবি, চির নবীনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিস্ময় হয়ে জন্মেছিলেন এই বঙ্গে। বিশ শতকের বিশ্ব তাঁকে চেনেনি, একুশ শতকের বিশ্ব কি চিনে নেবে সেই বিস্ময়কে, যখন তাঁর ভাষা যারা বোঝে তারাও চিনতে পারেনি তাঁকে। তাই তিনি আজও ‘কবর সবর করিয়া’ আছেন—সেই যৌবনের প্রতীক্ষায়, সেই তারুণ্যের প্রতীক্ষায়, সেই নবীনের প্রতীক্ষায়—যারা তাজ-ব-তাজার গাহিয়া গান, সজীব করিবে মহাশ্মশান।
নজরুল কবরে বসেও দেখতে পান তারুণ্যের দুর্দশা, যে তারুণ্য অসাম্য ও কুিসতকে ধ্বংস করে পরম সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন এই পৃথিবীকে ‘অজর অমর’ করে রাখবে—তাই ‘অভয়-সুন্দর’ কবিতায় নজরুলের উচ্চারণ—
কুিসত যাহা, অসাম্য যাহা সুন্দর ধরণীতে
হে পরম সুন্দরের পূজারী! হবে তাহা বিনাশিতে।
তব প্রোজ্জ্বল প্রাণের বহ্নি-শিখায় দহিতে তারে
যৌবন ঐশ্বর্য শক্তি লয়ে আসে বারে বারে।
যৌবনের এ ধর্ম, বন্ধু, সংহার করি জরা
অজর অমর করিয়া রাখে এ প্রাচীনা বসুন্ধরা।
যৌবনের এ ধর্ম হারায়ে বিধর্মী তরুণেরা—
হেরিতেছি আজ ভারতে—রয়েছে জরার শকুনে ঘেরা।
পাঠক অনায়াসে ‘ভারত’ শব্দের স্থলে ‘এদেশে’ পড়ে নিতে পারেন কিংবা ‘বিশ্বে’। সমগ্র পৃথিবী এখন ‘লোভী ও ভোগী’দের দখলে। নজরুল বিশ্বমানবতার কবি। তিনি ধর্মের কবি। সব অর্ধমই তাঁর পায়ের তলে মূর্ছিত হয়ে যায়। সব ধর্মের মর্ম-চেতনাই তাঁর মর্মমূলে একাকার হয়ে যায়। জাতীয়তাবোধে জারিত নজরুলের জীবন-দর্শন মূলত বৈশ্বিক। ধর্মহীন লোভী ও ভোগীদের প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রতিষ্ঠা-কাম্য এক বিশ্ব-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নজরুল ধর্মীয়-চেতনায় জারিত এক বিকল্প বিশ্ব-ব্যবস্থার কথা বলেন, যেখানে সুন্দরের (এক আল্লাহ) পূজা-অর্চনা তথা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য। তাই ‘লোভী ও ভোগী’দের এই সভ্যতার মূলে আঘাত করেন নজরুল কঠোর হস্তে। আর বিদ্রূপ করেন তরুণদের— যে তরুণেরা যৌবনের ধর্ম হারায়ে বিধর্মী হয়ে গেছে, ‘লোভী ও ভোগী’দের ফাঁদে পা দিয়ে ‘জরার শকুনে’ ঘেরাও হয়ে আছে।
এ কবিতায় নজরুল এই জরাগ্রস্ত সভ্যতার এক অপূর্ব চিত্র আমাদের মানসপাটে গেঁথে দিয়েছেন। এই চিত্র-নির্মাণে তিনি হিন্দু-পুরাণের এক ভোগবাদী রাজাকে হাজির করেছেন। এর নাম ‘যযাতি’। এই ‘যযাতি’ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অভিশাপে তার আপন যৌবন হারিয়েছে। আপন বিলাস ভোগের জন্য সে তার পুত্রের কাছে পুত্রের যৌবন যাচনা করেছে। তার কনিষ্ঠ পুত্র পিতার জরা গ্রহণ করে নিজ যৌবন পিতাকে দিয়েছে। ‘যযাতি’ পুত্রের যৌবন গ্রহণ করে আবার ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত সে হাস্যকর চিত্র, যা দেখে ভোগবাদীরা পরমানন্দে হাসে, আর ‘সত্য পথের তীর্থ পথিক’ পরম সুন্দরের পূজারীরা আঁখি-জলে ভাসে—
যৌবনে করি বাহন তাহার জরা চলে রাজ-পথে
হাসিছে বৃদ্ধ যুবক সাজিয়া যৌবন-শক্তি-রথে
জ্ঞান-বৃদ্ধের দন্তবিহীন বৈদান্তিক হাসি
দেখিছ তোমরা পরমানন্দে—আমি আঁঁখি-জলে ভাসি
বলা হয়ে থাকে, যৌবনের ইবাদত আল্লাহর কাছে বেশি কবুলযোগ্য। যৌবনের ইবাদত মানেই পরম সুন্দরের পূজা আর জরার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই। নজরুল এই সংজ্ঞার্থ ‘অভয়-সুন্দর’ কবিতার শুরুতেই উল্লেখ করেছেন। এ কবিতায় নজরুল তার স্বীয় জীবন-দর্শনের মূল তত্ত্ব আবারও উচ্চারণ করেছেন। এই তত্ত্বের মূলে আছে প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধন। যৌবন আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় যে, যারা বেহেশতে ঠাঁই পাবে তারা তাদের যৌবন নিয়েই সেখানে বসবাস করবে। নজরুল তাঁর অন্য একটি কবিতায় এ প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন। যে যৌবন আল্লাহর কাছে সমর্পিত অর্থাত্ পরম সুন্দরের পূজারী, সে যৌবন আল্লাহর শক্তিতে বলীয়ান। তাই যৌবন শক্তিকে যারা ভোগের বাহন বানায়, সেসব তরুণের প্রতি নজরুলের করুণামাখা উচ্চারণ—
মহাশক্তির প্রসাদ পাইয়া চিনিলে না হায় তারে
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া ফিরিতেছ দ্বারে দ্বারে।
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া দ্বারে দ্বারে ঘোরার এই দৃশ্যকল্পটিও নির্মম হাস্যকর, যে শিবকে নজরুল এ কবিতার অন্য একটি পঙিক্ততে বলেছেন ‘ভোলানাথ শিব মহারুদ্র’। যারা এ নির্মম দৃশ্যকল্প নির্মাণ করে, তাদের প্রতি নজরুলের তাই পরিণামদর্শী উচ্চারণ—
পেয়ে ভগবদ্-শক্তি যাহারা চিনিতে পারে না তারে
তাহাদের গতি চিরদিন ঐ তমসার কারাগারে।
এই তরুণদের তিনি ‘হস্তী-মূর্খ’ বলেও গাল দিয়েছেন—
ঐরাবতেরে চালায় মাহুত শুধু বুদ্ধির ছলে—
হে তরুণ, তুমি জানো কী ‘হস্তী-মূর্খ’ কাহারে বলে?
অপরিমাণ শক্তি লইয়া ভাবিছ শক্তি-হীন—
জরারে সেবিয়া লভিতেছ জরা, হইতেছ আয়ু-ক্ষীণ।
তারুণ্যের এই অধঃপতনের জন্য নজরুল ‘ধূর্ত বুদ্ধি-জীবী’ ও রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। ধূর্ত বুদ্ধিজীবীরা তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করে। সঠিক পথ প্রদর্শনের পরিবর্তে তাদের ‘ভোগী ও লোভী’দের নৌকায় তুলে দেয়। আর রাজনীতিকরা এদের হাতে তুলে দেয় ভোট-ভিক্ষার ঝুলি। ফলে পরম সুন্দরের কাছে, পরম করুণাময়ের কাছে শক্তি-ভিক্ষার পরিবর্তে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করে মূলত জরার সেবকে পরিণত হয়। তাই নজরুলের প্রশ্নবোধক উচ্চারণ—
ধূর্ত বুদ্ধি-জীবীর কাছে কি শক্তি মানিবে হার?
ক্ষুদ্রে রুধিবে ভোলানাথ শিব মহারুদ্রের দ্বার?
নজরুলের কাছে যৌবন হচ্ছে সূর্যের আলোর মতো। প্রচলিত রাজনীতি সেই যৌবন শক্তির সূর্যালোককে উনুনে পরিণত করে।
নজরুলের ভাষায়—
শক্তি ভিক্ষা করিবে যাহারা ভোট-ভিক্ষুক তারা!
চেনো কি—সূর্য-জ্যোতিরে লইয়া উনুন করেছে যারা?
এই ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, ‘ক্ষুদ্র’ও বটে, আর রাজনীতিক এদেশে ‘কচুরিপানা’র মতোই বিস্তারিত হয়েছে বিস্তর। এদের ঘেরাটোপের মধ্যে পুরোপুরি বন্দি হয়ে পড়েছে এদেশের যুব শক্তি। এই কচুরিপানা ধ্বংস করে দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন নজরুল তাঁর ‘কচুরিপানা’ নামের একটি গানে। তিনি বলেছেন, এদের যদি ধ্বংস করা না হয়, তাহলে এরাই আমাদের ধ্বংস করে ছাড়বে। পরিস্থিতি এখন সেই পরিসর দখল করে নিয়েছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে দেশ—কচুরিপানা ধ্বংস না করার পরিণতি। নজরুল এই কচুরিপানার স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন—
(এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুর ছানা\
ইহাদের সবংশে কর কর নাশ,
এদের দগ্ধ করে কর ছাই পাঁশ
(এরা) জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস
-----------------------
(কাল) সাপের ফণা এরা পাতায় পাতায়,
(এরা) রক্তবীজের ঝাড়, মরিতে না চায়
(ভাই) এরা না মরিলে মোরা মরিব সবাই
(এরে) নির্মূল করে ফেল, শুন না মানা
ধ্বংস কর এই কচুরিপানা\
আর যারা মানবিক-সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে কেবল শিল্পের জন্য শিল্প চর্চায় নিবিষ্ট রয়েছে, তাদের সম্পর্কে নজরুল ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ কবিতায় বলেছেন—
ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি
তোমরা দেখেছ ঊর্ধ্বের শশী, রবি!
তোমরা তাঁহার সুন্দর সৃষ্টিরে,
রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে।
তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপ-মালা
করে না ক কেন কাঙালের ঘর আলা?
এত জ্ঞান এত শক্তি বিলাস সে কি?
আলো তার দূর কুটিরে যায় না কোন্ সে শিলায় ঠেকি?
মহান আল্লাহর সৃষ্টি জগত্ নিয়েই এরা রস রচনা করে। অথচ এরা আল্লাহকে ভুলে, আল্লাহর সৃষ্টির সেবা ভুলে জ্ঞান আর শিল্পশক্তির বিলাসে মত্ত। এদের সম্পর্কে নজরুলের শেষ সিদ্ধান্ত—
যাহারা বুদ্ধিজীবী, সৈনিক হবে না তাহারা কভু,
তারা কল্যাণ আনেনি কখনো, তারা বুদ্ধির প্রভু।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এই ধূর্ত-বুদ্ধিজীবীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে মানা করে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এরা বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় এবং যা বলে তা তারা করে না। মহামতি ‘প্লেটো’ তার ‘রিপাবলিক’ থেকে এদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন প্রায় একই কারণে। দ্বিধাহীন নজরুলের অভিধানে এরা তাই ‘বুদ্ধির প্রভু’, ‘ধূর্ত বুদ্ধি-জীবী’। এরা কখনোই কল্যাণ আনতে পারে না। কেননা, এদের কোনো ধর্ম নেই, এরা অধর্মের দোসর। লোভ এবং ভোগের শিলা এদের জ্ঞানের আলোকে ঠেকিয়ে রাখে। এদের জ্ঞানের আলো কেবল তখত্-লোভী অসুর দলের প্রাসাদকেই আলোকিত করে রাখে। আজকের বাংলাদেশে এদের আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না—এরা এতই দৃশ্যমান। অন্যদিকে, রাজনীতিকরা যখন ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে তারুণ্যের অপরিসীম শক্তিকে দাস বানিয়ে দেয় আর চাকরিলোভী তরুণেরা সেই মোহে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন নজরুল ওইসব তরুণকে উদ্দেশ করে বলেন—
চাকুরি করিয়া পিতামাদের সুখী করিতে কি চাহ?
তাই হইয়াছ নুড়ো মুখ যত বুড়োর তলিপ বাহ?
চাকর হইয়া বংশের তুমি করিবে মুখোজ্জ্বল?
অন্তরে পেয়ে অমৃত, অন্ধ, মাগিতেছ হলাহল!
আর যারা তখত্-লোভীদের চাকরে পরিণত হয়েছে তাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন—
হউক সে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কি মন্ত্রী কমিশনার—
স্বর্ণের গলা-বন্ধ পরুক—সারমেয় নাম তার!
দাস হইবার সাধনা যাহার নহে সে তরুণ নহে—
যৌবন শুধু মুখোশ তাহার—ভিতরে জরারে বহে।
‘সারমেয়’ শব্দের অর্থ যে ‘কুকুর’, এ তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার অবকাশ রয়ে গেছে। ‘নাকের বদলে নরুন’ চাওয়া এসব তরুণকে প্রত্যাখ্যান করে নজরুল আজাদ মুক্ত-স্বাধীন চিত্ত যুবাদের জয়গান গেয়ে চলেন। যেসব তরুণ পথের ভিখারি হতে রাজি তবু ‘সুবিধা-শিকারি’ হতে রাজি নয়, তাদেরই জয়গাথা চিরদিন গেয়ে বেড়ান নজরুল। তাদেরই তিনি করজোড়ে প্রণাম জানান, তাদের জন্যই তিনি মহাভিক্ষু সেজে তপস্যা করেন, তাদের জন্যই তিনি নিশিদিন ‘বাজো রে শিঙ্গা বাজো!’ মন্ত্র হেঁকে বেড়ান। তিনি বলেন—
সমাধির গিরি-গহ্বরে বসি তাহাদেরই পথ চাহি—
তাদেরই আভাস পেলে মনে হয় পাইলাম বাদশাহি!
মোর সমাধির পাশে এলে কেউ, ঢেউ ওঠে মোর বুকে—
‘মোর চির-চাওয়া বন্ধু এলে কি’ বলে চাহি তার মুখে।
জ্যোতি আছে, হায় গতি নাই হেরি তার মুখ পানে চেয়ে—
কবরে ‘সবর’ করিয়া আমার দিন যায় গান গেয়ে।
কারে চাই আমি কী যে চাই হায় বুঝে না উহারা কেহ।
দেহ দিতে চায় দেশের লাগিয়া, মন টানে তার গেহ।
নজরুলের কবরের কাছে যারা নিত্য আসা-যাওয়া করে, জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে কিংবা ভক্তি জানাতে অন্য কোনো দিনে—তাদেরও নজরুল প্রত্যাখ্যান করেন। তারা নজরুল-ভক্ত বটে, তবে আত্মশক্তিহীন। এদের মনে এখনও পার্থিব খায়েশ। এরা মুখে মুখে শহীদ হতে চায় কিন্তু অন্তর তাদের গৃহে বাঁধা। এরা ভীরু। নজরুল দেখতে পান এদের বুকে ভয়ের ছায়া—
আঁধারে থাকিয়া, বন্ধু, দিব্য দৃষ্টি গিয়াছে খুলে
আমি দেখিয়াছি তোমাদের বুকে ভয়ের যে ছায়া দুলে!
তোমরা ভাবিছ—আমি বাহিরিলে তোমরা ছুটিবে পিছে—
আপনাতে নাই বিশ্বাস যার—তাহার ভরসা মিছে!
নজরুল আত্মশক্তিতে বলীয়ান সেই তারুণ্যের আগমনের অপেক্ষায় ‘শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া’ ‘প্রতীক্ষারত’, যারা তাদের সেনাপতি শহীদ হয়ে যাওয়ার পরও সম্মুখসমরে অটল থেকে লড়তে থাকে। তিনি বলেন—
আমি যদি মরি সমুখ-সমরে—তবু যারা টলিবে না—
যুঝিবে আত্মশক্তির বলে তারাই অমর সেনা।
সেই সেনা দল সৃষ্টি যেদিন হইবে—সেদিন ভোরে
মোমের প্রদীপ নহে গো—অরুণ সূর্য দেখিব গোরে।
............
ভয়কে যাহারা ভুলিয়াছে—সেই অভয় তরুণ দল
আসিবে যেদিন—হাঁকিব সেদিন—‘সময় হয়েছে, চল্!’
এই অভয় তরুণ দলের কোনো পিছুটান থাকতে পারে না, স্নেহ-ভালোবাসার নীড়ও এদের কর্তব্যবিমুখ করতে পারে না। এজন্যই নজরুল বলেন—
কোথা গৃহ-হারা, স্নেহ-হারা ওরে ছন্নছাড়ার দল—
যাদের কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে টলমল।
পিছন চাওয়ার নাহি যার কেহ, নাই পিতামাতা জ্ঞাতি
তারা তো আসে না জ্বালাইতে মোর আঁধার কবরে বাতি।
নজরুল মজলুমের পরম-বন্ধু। অথচ নজরুলের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ঘটছে না। যারা দিনরাত নজরুল নিয়ে মাতামাতি করে, তারা তো সেই মজলুমদের কেউ নয়। বরং এরা সংসার-সুখের মায়ায় জড়িয়ে রেখে নিজেদের শক্তিকে অবিরাম অপমান করে চলেছে। নিজেরা সুখের জন্য বেকারার, কিন্তু অসুখী মজলুমের যে কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে, সে কাঁদন এরা শুনতে পায় না। এরা লক্ষ টাকার শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে গান গায়—
‘তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহেলিল্লাহ্’।
সুতরাং মজলুমের ডাকে যারা সব পিছুটান-শৃঙ্খল ছিঁড়ে সুখ-শয্যা ত্যাগ করে ছুটে যায়, তারাই নজরুলের অভিধানে ‘অমর সেনা’। এই অমর সেনাদলের জন্যই নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন। নজরুল এই আত্মশক্তিতে বলীয়ান সেনাদলের হাতেই নিজের পতাকা তুলে দিতে চান। এদের সিপাহসালার হওয়াই তাঁর চিরকালের সাধনা। অতএব তিনি বলেন—
আমি গেলে যারা আমার পতাকা ধরিবে বিপুল বলে—
সেই সে অগ্র-পথিকের দল এস এস পথ-তলে!
সেদিন মৌন সমাধি-মগ্ন ইসরাফিলের বাঁশি
বাজিয়া উঠিবে—টুটিবে দেশের তমসা সর্বনাশী!
এদেশের বুক থেকে ‘তমসা সর্বনাশী’কে বিদায় করতে হলে সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি করতে হবে, যারা নজরুলের পতাকা ‘ধরিবে বিপুল বলে’। এই ‘আজাদ মুক্ত-স্বাধীন চিত্ত’ সেনাদল কে সৃষ্টি করবে? যারা আধিপত্যকামী, তারা? যারা ফ্যাসিবাদী, তারা? যারা ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, তারা? যারা লোভী-ভোগী, তারা? অসম্ভব, এদের হাতে কখনোই সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি হবে না। তাই ‘অজর অমর’ নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন, ‘শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া’ প্রতীক্ষা করে আছেন ভগবত্-শক্তিতে শক্তিমান, আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান সেই তরুণদের; যারা আপনিই আপনাকে সৃষ্টি করবে, ঐশী শক্তির কৃপা ভিক্ষা করে যারা নিজেরাই ঐশী শক্তির আধার হয়ে উঠবে—তারা অমর, তারা অজর, তারা অবিনাশী, তারা পুরুষোত্তম সত্য।
আর কোন্ মোহন বাঁশিতে ফুঁক দেয়া বাকি ছিল তাঁর? আর কোন্ কথা বলা বাকি ছিল তাঁর? হয়তো অনেক কথাই বলা হয়নি তাঁর! হয়তো অনেক বাঁশিই ছোঁয়া হয়নি তাঁর! তবু যত সুরে তিনি বাজিয়েছেন তাঁর অন্তরের আকাঙ্ক্ষা, যত উচ্চারণে উচ্চকিত করেছেন নিজ-সত্তাকে—তার কতটুকুই বা ধরতে পেরেছে আজও এই বৃহত্ বঙ্গের মানুষ। তার রুদ্র-রূপ আমাদের এই মহা-ক্ষুদ্রতাকে আজও অবিরাম লজ্জা দিয়ে যায়। কোথায় সে বীর, যার শির দেখে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া নত হয়ে গেল!
চির যৌবনের কবি, চির তারুণ্যের কবি, চির নবীনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিস্ময় হয়ে জন্মেছিলেন এই বঙ্গে। বিশ শতকের বিশ্ব তাঁকে চেনেনি, একুশ শতকের বিশ্ব কি চিনে নেবে সেই বিস্ময়কে, যখন তাঁর ভাষা যারা বোঝে তারাও চিনতে পারেনি তাঁকে। তাই তিনি আজও ‘কবর সবর করিয়া’ আছেন—সেই যৌবনের প্রতীক্ষায়, সেই তারুণ্যের প্রতীক্ষায়, সেই নবীনের প্রতীক্ষায়—যারা তাজ-ব-তাজার গাহিয়া গান, সজীব করিবে মহাশ্মশান।
নজরুল কবরে বসেও দেখতে পান তারুণ্যের দুর্দশা, যে তারুণ্য অসাম্য ও কুিসতকে ধ্বংস করে পরম সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন এই পৃথিবীকে ‘অজর অমর’ করে রাখবে—তাই ‘অভয়-সুন্দর’ কবিতায় নজরুলের উচ্চারণ—
কুিসত যাহা, অসাম্য যাহা সুন্দর ধরণীতে
হে পরম সুন্দরের পূজারী! হবে তাহা বিনাশিতে।
তব প্রোজ্জ্বল প্রাণের বহ্নি-শিখায় দহিতে তারে
যৌবন ঐশ্বর্য শক্তি লয়ে আসে বারে বারে।
যৌবনের এ ধর্ম, বন্ধু, সংহার করি জরা
অজর অমর করিয়া রাখে এ প্রাচীনা বসুন্ধরা।
যৌবনের এ ধর্ম হারায়ে বিধর্মী তরুণেরা—
হেরিতেছি আজ ভারতে—রয়েছে জরার শকুনে ঘেরা।
পাঠক অনায়াসে ‘ভারত’ শব্দের স্থলে ‘এদেশে’ পড়ে নিতে পারেন কিংবা ‘বিশ্বে’। সমগ্র পৃথিবী এখন ‘লোভী ও ভোগী’দের দখলে। নজরুল বিশ্বমানবতার কবি। তিনি ধর্মের কবি। সব অর্ধমই তাঁর পায়ের তলে মূর্ছিত হয়ে যায়। সব ধর্মের মর্ম-চেতনাই তাঁর মর্মমূলে একাকার হয়ে যায়। জাতীয়তাবোধে জারিত নজরুলের জীবন-দর্শন মূলত বৈশ্বিক। ধর্মহীন লোভী ও ভোগীদের প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রতিষ্ঠা-কাম্য এক বিশ্ব-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নজরুল ধর্মীয়-চেতনায় জারিত এক বিকল্প বিশ্ব-ব্যবস্থার কথা বলেন, যেখানে সুন্দরের (এক আল্লাহ) পূজা-অর্চনা তথা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য। তাই ‘লোভী ও ভোগী’দের এই সভ্যতার মূলে আঘাত করেন নজরুল কঠোর হস্তে। আর বিদ্রূপ করেন তরুণদের— যে তরুণেরা যৌবনের ধর্ম হারায়ে বিধর্মী হয়ে গেছে, ‘লোভী ও ভোগী’দের ফাঁদে পা দিয়ে ‘জরার শকুনে’ ঘেরাও হয়ে আছে।
এ কবিতায় নজরুল এই জরাগ্রস্ত সভ্যতার এক অপূর্ব চিত্র আমাদের মানসপাটে গেঁথে দিয়েছেন। এই চিত্র-নির্মাণে তিনি হিন্দু-পুরাণের এক ভোগবাদী রাজাকে হাজির করেছেন। এর নাম ‘যযাতি’। এই ‘যযাতি’ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অভিশাপে তার আপন যৌবন হারিয়েছে। আপন বিলাস ভোগের জন্য সে তার পুত্রের কাছে পুত্রের যৌবন যাচনা করেছে। তার কনিষ্ঠ পুত্র পিতার জরা গ্রহণ করে নিজ যৌবন পিতাকে দিয়েছে। ‘যযাতি’ পুত্রের যৌবন গ্রহণ করে আবার ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত সে হাস্যকর চিত্র, যা দেখে ভোগবাদীরা পরমানন্দে হাসে, আর ‘সত্য পথের তীর্থ পথিক’ পরম সুন্দরের পূজারীরা আঁখি-জলে ভাসে—
যৌবনে করি বাহন তাহার জরা চলে রাজ-পথে
হাসিছে বৃদ্ধ যুবক সাজিয়া যৌবন-শক্তি-রথে
জ্ঞান-বৃদ্ধের দন্তবিহীন বৈদান্তিক হাসি
দেখিছ তোমরা পরমানন্দে—আমি আঁঁখি-জলে ভাসি
বলা হয়ে থাকে, যৌবনের ইবাদত আল্লাহর কাছে বেশি কবুলযোগ্য। যৌবনের ইবাদত মানেই পরম সুন্দরের পূজা আর জরার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই। নজরুল এই সংজ্ঞার্থ ‘অভয়-সুন্দর’ কবিতার শুরুতেই উল্লেখ করেছেন। এ কবিতায় নজরুল তার স্বীয় জীবন-দর্শনের মূল তত্ত্ব আবারও উচ্চারণ করেছেন। এই তত্ত্বের মূলে আছে প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধন। যৌবন আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় যে, যারা বেহেশতে ঠাঁই পাবে তারা তাদের যৌবন নিয়েই সেখানে বসবাস করবে। নজরুল তাঁর অন্য একটি কবিতায় এ প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন। যে যৌবন আল্লাহর কাছে সমর্পিত অর্থাত্ পরম সুন্দরের পূজারী, সে যৌবন আল্লাহর শক্তিতে বলীয়ান। তাই যৌবন শক্তিকে যারা ভোগের বাহন বানায়, সেসব তরুণের প্রতি নজরুলের করুণামাখা উচ্চারণ—
মহাশক্তির প্রসাদ পাইয়া চিনিলে না হায় তারে
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া ফিরিতেছ দ্বারে দ্বারে।
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া দ্বারে দ্বারে ঘোরার এই দৃশ্যকল্পটিও নির্মম হাস্যকর, যে শিবকে নজরুল এ কবিতার অন্য একটি পঙিক্ততে বলেছেন ‘ভোলানাথ শিব মহারুদ্র’। যারা এ নির্মম দৃশ্যকল্প নির্মাণ করে, তাদের প্রতি নজরুলের তাই পরিণামদর্শী উচ্চারণ—
পেয়ে ভগবদ্-শক্তি যাহারা চিনিতে পারে না তারে
তাহাদের গতি চিরদিন ঐ তমসার কারাগারে।
এই তরুণদের তিনি ‘হস্তী-মূর্খ’ বলেও গাল দিয়েছেন—
ঐরাবতেরে চালায় মাহুত শুধু বুদ্ধির ছলে—
হে তরুণ, তুমি জানো কী ‘হস্তী-মূর্খ’ কাহারে বলে?
অপরিমাণ শক্তি লইয়া ভাবিছ শক্তি-হীন—
জরারে সেবিয়া লভিতেছ জরা, হইতেছ আয়ু-ক্ষীণ।
তারুণ্যের এই অধঃপতনের জন্য নজরুল ‘ধূর্ত বুদ্ধি-জীবী’ ও রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। ধূর্ত বুদ্ধিজীবীরা তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করে। সঠিক পথ প্রদর্শনের পরিবর্তে তাদের ‘ভোগী ও লোভী’দের নৌকায় তুলে দেয়। আর রাজনীতিকরা এদের হাতে তুলে দেয় ভোট-ভিক্ষার ঝুলি। ফলে পরম সুন্দরের কাছে, পরম করুণাময়ের কাছে শক্তি-ভিক্ষার পরিবর্তে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করে মূলত জরার সেবকে পরিণত হয়। তাই নজরুলের প্রশ্নবোধক উচ্চারণ—
ধূর্ত বুদ্ধি-জীবীর কাছে কি শক্তি মানিবে হার?
ক্ষুদ্রে রুধিবে ভোলানাথ শিব মহারুদ্রের দ্বার?
নজরুলের কাছে যৌবন হচ্ছে সূর্যের আলোর মতো। প্রচলিত রাজনীতি সেই যৌবন শক্তির সূর্যালোককে উনুনে পরিণত করে।
নজরুলের ভাষায়—
শক্তি ভিক্ষা করিবে যাহারা ভোট-ভিক্ষুক তারা!
চেনো কি—সূর্য-জ্যোতিরে লইয়া উনুন করেছে যারা?
এই ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, ‘ক্ষুদ্র’ও বটে, আর রাজনীতিক এদেশে ‘কচুরিপানা’র মতোই বিস্তারিত হয়েছে বিস্তর। এদের ঘেরাটোপের মধ্যে পুরোপুরি বন্দি হয়ে পড়েছে এদেশের যুব শক্তি। এই কচুরিপানা ধ্বংস করে দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন নজরুল তাঁর ‘কচুরিপানা’ নামের একটি গানে। তিনি বলেছেন, এদের যদি ধ্বংস করা না হয়, তাহলে এরাই আমাদের ধ্বংস করে ছাড়বে। পরিস্থিতি এখন সেই পরিসর দখল করে নিয়েছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে দেশ—কচুরিপানা ধ্বংস না করার পরিণতি। নজরুল এই কচুরিপানার স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন—
(এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুর ছানা\
ইহাদের সবংশে কর কর নাশ,
এদের দগ্ধ করে কর ছাই পাঁশ
(এরা) জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস
-----------------------
(কাল) সাপের ফণা এরা পাতায় পাতায়,
(এরা) রক্তবীজের ঝাড়, মরিতে না চায়
(ভাই) এরা না মরিলে মোরা মরিব সবাই
(এরে) নির্মূল করে ফেল, শুন না মানা
ধ্বংস কর এই কচুরিপানা\
আর যারা মানবিক-সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে কেবল শিল্পের জন্য শিল্প চর্চায় নিবিষ্ট রয়েছে, তাদের সম্পর্কে নজরুল ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ কবিতায় বলেছেন—
ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি
তোমরা দেখেছ ঊর্ধ্বের শশী, রবি!
তোমরা তাঁহার সুন্দর সৃষ্টিরে,
রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে।
তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপ-মালা
করে না ক কেন কাঙালের ঘর আলা?
এত জ্ঞান এত শক্তি বিলাস সে কি?
আলো তার দূর কুটিরে যায় না কোন্ সে শিলায় ঠেকি?
মহান আল্লাহর সৃষ্টি জগত্ নিয়েই এরা রস রচনা করে। অথচ এরা আল্লাহকে ভুলে, আল্লাহর সৃষ্টির সেবা ভুলে জ্ঞান আর শিল্পশক্তির বিলাসে মত্ত। এদের সম্পর্কে নজরুলের শেষ সিদ্ধান্ত—
যাহারা বুদ্ধিজীবী, সৈনিক হবে না তাহারা কভু,
তারা কল্যাণ আনেনি কখনো, তারা বুদ্ধির প্রভু।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এই ধূর্ত-বুদ্ধিজীবীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে মানা করে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এরা বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় এবং যা বলে তা তারা করে না। মহামতি ‘প্লেটো’ তার ‘রিপাবলিক’ থেকে এদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন প্রায় একই কারণে। দ্বিধাহীন নজরুলের অভিধানে এরা তাই ‘বুদ্ধির প্রভু’, ‘ধূর্ত বুদ্ধি-জীবী’। এরা কখনোই কল্যাণ আনতে পারে না। কেননা, এদের কোনো ধর্ম নেই, এরা অধর্মের দোসর। লোভ এবং ভোগের শিলা এদের জ্ঞানের আলোকে ঠেকিয়ে রাখে। এদের জ্ঞানের আলো কেবল তখত্-লোভী অসুর দলের প্রাসাদকেই আলোকিত করে রাখে। আজকের বাংলাদেশে এদের আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না—এরা এতই দৃশ্যমান। অন্যদিকে, রাজনীতিকরা যখন ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে তারুণ্যের অপরিসীম শক্তিকে দাস বানিয়ে দেয় আর চাকরিলোভী তরুণেরা সেই মোহে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন নজরুল ওইসব তরুণকে উদ্দেশ করে বলেন—
চাকুরি করিয়া পিতামাদের সুখী করিতে কি চাহ?
তাই হইয়াছ নুড়ো মুখ যত বুড়োর তলিপ বাহ?
চাকর হইয়া বংশের তুমি করিবে মুখোজ্জ্বল?
অন্তরে পেয়ে অমৃত, অন্ধ, মাগিতেছ হলাহল!
আর যারা তখত্-লোভীদের চাকরে পরিণত হয়েছে তাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন—
হউক সে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কি মন্ত্রী কমিশনার—
স্বর্ণের গলা-বন্ধ পরুক—সারমেয় নাম তার!
দাস হইবার সাধনা যাহার নহে সে তরুণ নহে—
যৌবন শুধু মুখোশ তাহার—ভিতরে জরারে বহে।
‘সারমেয়’ শব্দের অর্থ যে ‘কুকুর’, এ তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার অবকাশ রয়ে গেছে। ‘নাকের বদলে নরুন’ চাওয়া এসব তরুণকে প্রত্যাখ্যান করে নজরুল আজাদ মুক্ত-স্বাধীন চিত্ত যুবাদের জয়গান গেয়ে চলেন। যেসব তরুণ পথের ভিখারি হতে রাজি তবু ‘সুবিধা-শিকারি’ হতে রাজি নয়, তাদেরই জয়গাথা চিরদিন গেয়ে বেড়ান নজরুল। তাদেরই তিনি করজোড়ে প্রণাম জানান, তাদের জন্যই তিনি মহাভিক্ষু সেজে তপস্যা করেন, তাদের জন্যই তিনি নিশিদিন ‘বাজো রে শিঙ্গা বাজো!’ মন্ত্র হেঁকে বেড়ান। তিনি বলেন—
সমাধির গিরি-গহ্বরে বসি তাহাদেরই পথ চাহি—
তাদেরই আভাস পেলে মনে হয় পাইলাম বাদশাহি!
মোর সমাধির পাশে এলে কেউ, ঢেউ ওঠে মোর বুকে—
‘মোর চির-চাওয়া বন্ধু এলে কি’ বলে চাহি তার মুখে।
জ্যোতি আছে, হায় গতি নাই হেরি তার মুখ পানে চেয়ে—
কবরে ‘সবর’ করিয়া আমার দিন যায় গান গেয়ে।
কারে চাই আমি কী যে চাই হায় বুঝে না উহারা কেহ।
দেহ দিতে চায় দেশের লাগিয়া, মন টানে তার গেহ।
নজরুলের কবরের কাছে যারা নিত্য আসা-যাওয়া করে, জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে কিংবা ভক্তি জানাতে অন্য কোনো দিনে—তাদেরও নজরুল প্রত্যাখ্যান করেন। তারা নজরুল-ভক্ত বটে, তবে আত্মশক্তিহীন। এদের মনে এখনও পার্থিব খায়েশ। এরা মুখে মুখে শহীদ হতে চায় কিন্তু অন্তর তাদের গৃহে বাঁধা। এরা ভীরু। নজরুল দেখতে পান এদের বুকে ভয়ের ছায়া—
আঁধারে থাকিয়া, বন্ধু, দিব্য দৃষ্টি গিয়াছে খুলে
আমি দেখিয়াছি তোমাদের বুকে ভয়ের যে ছায়া দুলে!
তোমরা ভাবিছ—আমি বাহিরিলে তোমরা ছুটিবে পিছে—
আপনাতে নাই বিশ্বাস যার—তাহার ভরসা মিছে!
নজরুল আত্মশক্তিতে বলীয়ান সেই তারুণ্যের আগমনের অপেক্ষায় ‘শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া’ ‘প্রতীক্ষারত’, যারা তাদের সেনাপতি শহীদ হয়ে যাওয়ার পরও সম্মুখসমরে অটল থেকে লড়তে থাকে। তিনি বলেন—
আমি যদি মরি সমুখ-সমরে—তবু যারা টলিবে না—
যুঝিবে আত্মশক্তির বলে তারাই অমর সেনা।
সেই সেনা দল সৃষ্টি যেদিন হইবে—সেদিন ভোরে
মোমের প্রদীপ নহে গো—অরুণ সূর্য দেখিব গোরে।
............
ভয়কে যাহারা ভুলিয়াছে—সেই অভয় তরুণ দল
আসিবে যেদিন—হাঁকিব সেদিন—‘সময় হয়েছে, চল্!’
এই অভয় তরুণ দলের কোনো পিছুটান থাকতে পারে না, স্নেহ-ভালোবাসার নীড়ও এদের কর্তব্যবিমুখ করতে পারে না। এজন্যই নজরুল বলেন—
কোথা গৃহ-হারা, স্নেহ-হারা ওরে ছন্নছাড়ার দল—
যাদের কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে টলমল।
পিছন চাওয়ার নাহি যার কেহ, নাই পিতামাতা জ্ঞাতি
তারা তো আসে না জ্বালাইতে মোর আঁধার কবরে বাতি।
নজরুল মজলুমের পরম-বন্ধু। অথচ নজরুলের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ঘটছে না। যারা দিনরাত নজরুল নিয়ে মাতামাতি করে, তারা তো সেই মজলুমদের কেউ নয়। বরং এরা সংসার-সুখের মায়ায় জড়িয়ে রেখে নিজেদের শক্তিকে অবিরাম অপমান করে চলেছে। নিজেরা সুখের জন্য বেকারার, কিন্তু অসুখী মজলুমের যে কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে, সে কাঁদন এরা শুনতে পায় না। এরা লক্ষ টাকার শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে গান গায়—
‘তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহেলিল্লাহ্’।
সুতরাং মজলুমের ডাকে যারা সব পিছুটান-শৃঙ্খল ছিঁড়ে সুখ-শয্যা ত্যাগ করে ছুটে যায়, তারাই নজরুলের অভিধানে ‘অমর সেনা’। এই অমর সেনাদলের জন্যই নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন। নজরুল এই আত্মশক্তিতে বলীয়ান সেনাদলের হাতেই নিজের পতাকা তুলে দিতে চান। এদের সিপাহসালার হওয়াই তাঁর চিরকালের সাধনা। অতএব তিনি বলেন—
আমি গেলে যারা আমার পতাকা ধরিবে বিপুল বলে—
সেই সে অগ্র-পথিকের দল এস এস পথ-তলে!
সেদিন মৌন সমাধি-মগ্ন ইসরাফিলের বাঁশি
বাজিয়া উঠিবে—টুটিবে দেশের তমসা সর্বনাশী!
এদেশের বুক থেকে ‘তমসা সর্বনাশী’কে বিদায় করতে হলে সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি করতে হবে, যারা নজরুলের পতাকা ‘ধরিবে বিপুল বলে’। এই ‘আজাদ মুক্ত-স্বাধীন চিত্ত’ সেনাদল কে সৃষ্টি করবে? যারা আধিপত্যকামী, তারা? যারা ফ্যাসিবাদী, তারা? যারা ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, তারা? যারা লোভী-ভোগী, তারা? অসম্ভব, এদের হাতে কখনোই সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি হবে না। তাই ‘অজর অমর’ নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন, ‘শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া’ প্রতীক্ষা করে আছেন ভগবত্-শক্তিতে শক্তিমান, আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান সেই তরুণদের; যারা আপনিই আপনাকে সৃষ্টি করবে, ঐশী শক্তির কৃপা ভিক্ষা করে যারা নিজেরাই ঐশী শক্তির আধার হয়ে উঠবে—তারা অমর, তারা অজর, তারা অবিনাশী, তারা পুরুষোত্তম সত্য।
Monday, 21 May 2012
নজরুলের শেষ জীবনের সাক্ষী কবি ভবন
নজরুলের শেষ জীবনের সাক্ষী কবি ভবন: হাসান শান্তনু
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/05/21/146038
ঢাকার ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০ নম্বরের বাড়িটা ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাসভবন। কবির শেষ জীবনের সাক্ষী এ কবি ভবনে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল ইনস্টিটিউট। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেন। নজরুলের স্মৃতিরক্ষা, তার জীবন, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, রচনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশনা ও প্রচার আর দেশ-বিদেশে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার জন্য প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। কবি ভবনের যে ঘরে কবি ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত ৩ বছর ১ মাস ২৮ দিন ছিলেন, সেই ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল জাদুঘর। এতে সংরক্ষিত আছে কবির হস্তলিপির ফটোকপি, কবিতার বইয়ের দুর্লভ সংস্করণের ফটোকপি, দুর্লভ আলোকচিত্র, আদি গ্রামোফোন রেকর্ড, আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের অডিও ক্যাসেট আর অন্যান্য নজরুল স্মৃতিচিহ্ন। আছে নজরুল চিত্রকলা গ্যালারি, যা নজরুল বিষয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা। এসব চিত্রকর্ম দেশের প্রতিথযশা শিল্পীদের নজরুলের জীবন, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে আঁকা। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত নজরুল স্মৃতিচিহ্ন দেখতে জাদুঘরে আসেন নানা বয়সের নজরুলপ্রেমী।
তবে সরকারের চরম অবহেলার শিকার নজরুল ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি এখন পড়েছে মহাজোট সরকারের রোষানলে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের উদ্যোগ, পরিকল্পনা, প্রকল্প নেয়ায় সরকারের এ রোষানলের শিকার হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিবেচনায় জাতীয় কবির প্রতি উপেক্ষা, অবহেলাও এর কারণ বলে দায়ী করছেন নজরুল গবেষক, বিশেষজ্ঞরা। এ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বন্ধ হতে থাকে ইনস্টিটিউটের নানা কার্যক্রম। ফলে থেমে আছে নজরুল গবেষণা। নজরুলের বই আরবিসহ বিদেশি ভাষায় অনুবাদ, তার স্মৃতিজড়িত জায়গাগুলো ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র, তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ ও পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার কাজ প্রায় বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যাপ্ত লোকবল ও বাজেট নেই। জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। নজরুল জাদুঘরকে আজও সমৃদ্ধ করতে পারেননি ইনস্টিটিউট কর্মকর্তারা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নজরুল ইনস্টিটিউট নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি সীমিত সাধ্য দিয়েও নজরুল বিষয়ে গবেষণা করছে। প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী বই, নজরুলের দুর্লভ সঙ্গীতের সিডি, তথ্যচিত্র, পত্রিকা, স্মরণিকা, বুলেটিন, বর্ষপঞ্জি, পোস্টার ও উপহার সামগ্রী। সংগ্রহ করেছে নজরুল বিষয়ক দুর্লভ উপকরণ, তথ্য ও উপাত্ত। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত ‘নজরুল অ্যালবামে’ আছে কবির কৈশোরকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রামশীল, বর্ণাঢ্য ও সুখ-দুঃখময় দীর্ঘ জীবনের রঙিন, সাদা-কালো আলোকচিত্র। ইনস্টিটিউট প্রকাশ করেছে ‘নজরুল সঙ্গীত অভিধান’, ৩০টি খণ্ডে ৭৫০টি শুদ্ধ নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, নজরুলসঙ্গীতের সঙ্কলন ‘নজরুলসঙ্গীত সমগ্র’, পাকিস্তান থেকে সংগৃহীত নজরুলের হস্তলিপির পাণ্ডুলিপি ‘নজরুলের হারানো গানের খাতা’সহ আদি গ্রামোফান রেকর্ড থেকে ধারণকৃত নির্বাচিত নজরুলসঙ্গীতের অডিও সিডি। প্রতিষ্ঠানটি নজরুলের কবিতা, গানসহ অন্যান্য রচনা বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করছে। এ পর্যন্ত ইংরেজি, ফরাসি, উর্দু, ইতালি, তুর্কি ও চীনা ভাষায় নজরুলের কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনা অনূদিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘ইন দ্য আইজ অব কাজী নজরুল ইসলাম : কামাল পাশা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায়। ‘৮৬ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর নজরুল স্মৃতিপদক, নজরুল পদক দিচ্ছে। নজরুল সাহিত্য ও কর্মকাণ্ড সবস্তরে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটি নজরুলসঙ্গীত প্রশিক্ষণ কোর্স ও আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছে।
তবে নজরুল চর্চাবিষয়ক একমাত্র সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের বাজেটের বড় অংশ গবেষণার বদলে খরচ হচ্ছে এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, গাড়ির তেল ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তদের নেই নজরুল বিষয়ে গবেষণা। সরকারের অবহেলায় সেখানে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম বিরাজ করছে। গবেষণার বদলে বছরে নজরুল বিষয়ক ১২টি অনুষ্ঠান আয়োজনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটির মূল কর্মকাণ্ড। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নজরুলের স্মৃতিজড়িত স্থান, স্থাপনা দেখার সুযোগ করে দিতে ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ‘নজরুল পর্যটন’ চালুর উদ্যোগ নেয় ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এ প্রকল্প গত জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বন্ধ। নজরুল বিষয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৫ সালে ইনস্টিটিউটের চালু করা ‘বৃত্তি’ও বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটির ‘উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ (সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় সর্বশেষ বৃত্তি দেয়া হয় ২০০৬ সালে। নজরুলের স্মৃতিজড়িত স্থানগুলোর তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগও নেয়া হয় ওই বছর। ‘কুমিল্লায় নজরুল’, ‘ত্রিশালে নজরুল’, ‘চট্টগ্রামে নজরুল’ শিরোনামে ওই বছর ৩টি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। অন্য জায়গাগুলোর ওপর তথ্যচিত্র এখন নির্মাণ হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির পত্রিকা ‘ত্রৈমাসিক নজরুল ইনস্টিটিউট’ ও ইংরেজি ‘জার্নাল’ নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে না। ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত পুরনো বেশিরভাগ বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না। পুনর্মুদ্রণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। ইনস্টিটিউট ভবনের নিচতলার বিক্রয়কেন্দ্র, এমনকি এর লাইব্রেরিতেও অনেক বই নেই। নজরুলের স্বরলিপিও লাইব্রেরিতে খুঁজে পাচ্ছেন না পাঠক, গবেষকরা। কী কী কার্যক্রম এখন চলছে, এগুলোর সাম্প্রতিক তালিকা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের কাছে নেই। যেসব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, সেগুলো চালু করার উদ্যোগ নিতেও সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা আবেদন করছেন না। প্রতিষ্ঠানটির সাড়ে তিন শতাধিক প্রকাশিত বই থাকলেও বিক্রয়কেন্দ্র মাত্র একটি।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/05/21/146038
ঢাকার ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০ নম্বরের বাড়িটা ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাসভবন। কবির শেষ জীবনের সাক্ষী এ কবি ভবনে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল ইনস্টিটিউট। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেন। নজরুলের স্মৃতিরক্ষা, তার জীবন, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, রচনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশনা ও প্রচার আর দেশ-বিদেশে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার জন্য প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। কবি ভবনের যে ঘরে কবি ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত ৩ বছর ১ মাস ২৮ দিন ছিলেন, সেই ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল জাদুঘর। এতে সংরক্ষিত আছে কবির হস্তলিপির ফটোকপি, কবিতার বইয়ের দুর্লভ সংস্করণের ফটোকপি, দুর্লভ আলোকচিত্র, আদি গ্রামোফোন রেকর্ড, আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের অডিও ক্যাসেট আর অন্যান্য নজরুল স্মৃতিচিহ্ন। আছে নজরুল চিত্রকলা গ্যালারি, যা নজরুল বিষয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা। এসব চিত্রকর্ম দেশের প্রতিথযশা শিল্পীদের নজরুলের জীবন, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে আঁকা। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত নজরুল স্মৃতিচিহ্ন দেখতে জাদুঘরে আসেন নানা বয়সের নজরুলপ্রেমী।
তবে সরকারের চরম অবহেলার শিকার নজরুল ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি এখন পড়েছে মহাজোট সরকারের রোষানলে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের উদ্যোগ, পরিকল্পনা, প্রকল্প নেয়ায় সরকারের এ রোষানলের শিকার হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিবেচনায় জাতীয় কবির প্রতি উপেক্ষা, অবহেলাও এর কারণ বলে দায়ী করছেন নজরুল গবেষক, বিশেষজ্ঞরা। এ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বন্ধ হতে থাকে ইনস্টিটিউটের নানা কার্যক্রম। ফলে থেমে আছে নজরুল গবেষণা। নজরুলের বই আরবিসহ বিদেশি ভাষায় অনুবাদ, তার স্মৃতিজড়িত জায়গাগুলো ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র, তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ ও পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার কাজ প্রায় বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যাপ্ত লোকবল ও বাজেট নেই। জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। নজরুল জাদুঘরকে আজও সমৃদ্ধ করতে পারেননি ইনস্টিটিউট কর্মকর্তারা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নজরুল ইনস্টিটিউট নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি সীমিত সাধ্য দিয়েও নজরুল বিষয়ে গবেষণা করছে। প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী বই, নজরুলের দুর্লভ সঙ্গীতের সিডি, তথ্যচিত্র, পত্রিকা, স্মরণিকা, বুলেটিন, বর্ষপঞ্জি, পোস্টার ও উপহার সামগ্রী। সংগ্রহ করেছে নজরুল বিষয়ক দুর্লভ উপকরণ, তথ্য ও উপাত্ত। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত ‘নজরুল অ্যালবামে’ আছে কবির কৈশোরকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রামশীল, বর্ণাঢ্য ও সুখ-দুঃখময় দীর্ঘ জীবনের রঙিন, সাদা-কালো আলোকচিত্র। ইনস্টিটিউট প্রকাশ করেছে ‘নজরুল সঙ্গীত অভিধান’, ৩০টি খণ্ডে ৭৫০টি শুদ্ধ নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, নজরুলসঙ্গীতের সঙ্কলন ‘নজরুলসঙ্গীত সমগ্র’, পাকিস্তান থেকে সংগৃহীত নজরুলের হস্তলিপির পাণ্ডুলিপি ‘নজরুলের হারানো গানের খাতা’সহ আদি গ্রামোফান রেকর্ড থেকে ধারণকৃত নির্বাচিত নজরুলসঙ্গীতের অডিও সিডি। প্রতিষ্ঠানটি নজরুলের কবিতা, গানসহ অন্যান্য রচনা বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করছে। এ পর্যন্ত ইংরেজি, ফরাসি, উর্দু, ইতালি, তুর্কি ও চীনা ভাষায় নজরুলের কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনা অনূদিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘ইন দ্য আইজ অব কাজী নজরুল ইসলাম : কামাল পাশা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায়। ‘৮৬ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর নজরুল স্মৃতিপদক, নজরুল পদক দিচ্ছে। নজরুল সাহিত্য ও কর্মকাণ্ড সবস্তরে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটি নজরুলসঙ্গীত প্রশিক্ষণ কোর্স ও আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছে।
তবে নজরুল চর্চাবিষয়ক একমাত্র সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের বাজেটের বড় অংশ গবেষণার বদলে খরচ হচ্ছে এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, গাড়ির তেল ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তদের নেই নজরুল বিষয়ে গবেষণা। সরকারের অবহেলায় সেখানে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম বিরাজ করছে। গবেষণার বদলে বছরে নজরুল বিষয়ক ১২টি অনুষ্ঠান আয়োজনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটির মূল কর্মকাণ্ড। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নজরুলের স্মৃতিজড়িত স্থান, স্থাপনা দেখার সুযোগ করে দিতে ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ‘নজরুল পর্যটন’ চালুর উদ্যোগ নেয় ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এ প্রকল্প গত জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বন্ধ। নজরুল বিষয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৫ সালে ইনস্টিটিউটের চালু করা ‘বৃত্তি’ও বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটির ‘উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ (সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় সর্বশেষ বৃত্তি দেয়া হয় ২০০৬ সালে। নজরুলের স্মৃতিজড়িত স্থানগুলোর তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগও নেয়া হয় ওই বছর। ‘কুমিল্লায় নজরুল’, ‘ত্রিশালে নজরুল’, ‘চট্টগ্রামে নজরুল’ শিরোনামে ওই বছর ৩টি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। অন্য জায়গাগুলোর ওপর তথ্যচিত্র এখন নির্মাণ হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির পত্রিকা ‘ত্রৈমাসিক নজরুল ইনস্টিটিউট’ ও ইংরেজি ‘জার্নাল’ নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে না। ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত পুরনো বেশিরভাগ বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না। পুনর্মুদ্রণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। ইনস্টিটিউট ভবনের নিচতলার বিক্রয়কেন্দ্র, এমনকি এর লাইব্রেরিতেও অনেক বই নেই। নজরুলের স্বরলিপিও লাইব্রেরিতে খুঁজে পাচ্ছেন না পাঠক, গবেষকরা। কী কী কার্যক্রম এখন চলছে, এগুলোর সাম্প্রতিক তালিকা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের কাছে নেই। যেসব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, সেগুলো চালু করার উদ্যোগ নিতেও সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা আবেদন করছেন না। প্রতিষ্ঠানটির সাড়ে তিন শতাধিক প্রকাশিত বই থাকলেও বিক্রয়কেন্দ্র মাত্র একটি।
Sunday, 20 May 2012
ঢাকায় নজরুলের স্মৃতি
ঢাকায় নজরুলের স্মৃতিঃ হাসান শান্তনু
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/05/20/145916
ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নানা স্মৃতিজড়িত স্থান। কোথাও বসে কবি লিখেছিলেন কালজয়ী গান, কোথাও লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা। কোথাও বসে তিনি গেয়েছিলেন নিজ কণ্ঠে গান। কোথাও কবি দিয়েছিলেন নির্বাচনী বক্তৃতা। আবার কোথাও কবিকে ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষীরা জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত সংবর্ধনা। কবির স্মৃতিজড়িত স্থানের মধ্যে কোমল ঘাসের পার্ক থেকে শুরু করে আছে স্থাপত্যশৈলী, ঐতিহ্যঘেরা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর। রাষ্ট্রের চরম অবহেলায় এসব স্থান নিশ্চিহ্ন হতে বসলেও অনেক স্থান এখনও টিকে আছে কবির প্রতি মানুষের প্রবল ভালোবাসার টানে। সরকার, রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এসব স্থান রক্ষায় এগিয়ে না এলেও কবির প্রতি শ্রদ্ধা থেকে মানুষ অনেক স্থানে লাগিয়েছেন স্মৃতিফলক। গবেষকদের দেয়া তথ্যমতে, ঢাকার নানা এলাকা মিলিয়ে নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থান আছে ৩১টি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে জাতীয় কবির স্মৃতিময় এসব স্থান রক্ষায় সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। সংরক্ষণের অভাবে বদলে যাচ্ছে অনেক স্থান। সরেজমিনে অধিকাংশ স্থানে স্মৃতিফলক পর্যন্ত চোখে পড়েনি। এসব স্থানে স্মৃতিফলক লাগাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কাছে নজরুল ইনস্টিটিউট ২০০৬ সালে আবেদন করে। এ আবেদনে ডিসিসি আজও সাড়া দেয়নি।
ঢাকার যে কোনো দিক থেকে ঘুরলে নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থান দেখা যায়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের বাড়িতে আছে কবি ভবন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ’৭৫-এর ২২ জুলাই পর্যন্ত কবি এ বাড়িতে ছিলেন। পরিকল্পনার অভাবে এ বাড়ি লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে গেছে। বাড়িটির সামনে যে বাগানে কবি হাঁটতেন, ঘুরতেন—সেখানে এখন গাড়ির গ্যারেজ। সেই বাগান আর নেই। তবে বাড়িটিতে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুলচর্চা বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। এর প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহর দেয়া তথ্যমতে, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেন। নজরুলের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখা, তার জীবন, সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার জন্য তিনি কবি ভবন নামে প্রকল্পটি নেন। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর প্রকল্পটি তিন-চার বছর বন্ধ ছিল। এরশাদ সরকার প্রকল্পটির নাম বদলে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প নামে অনুমোদন দেয়। ওই সরকারের খেয়াল-খুশিমতই সেটি বাস্তবায়িত হয়।’
পুরনো ঢাকার ৫২ বেচারাম দেউড়ির মৌলভি আবদুল হাসনাত সাহেবের বাড়িতে বসে নজরুল একবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। বাড়িটির সামনের বাগানে বসে কবি লেখেন তার বিখ্যাত গান ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘দোলনচাঁপার হিন্দোলে’ বইয়ে উল্লেখ আছে—‘বেচারাম দেউড়িতে নজরুলের ভক্ত ছিলেন পীর সৈয়দ মোহাম্মদ ইউসুফ। তার জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে কবি ঢাকার ওই বাড়িতে ছিলেন।’
জানা যায়, নজরুল ঢাকায় এলে এ বাড়িতে থাকতেন। তবে যে ঘরে তিনি থাকতেন সেটি এখন তালাবদ্ধ। টিন দিয়ে ছাওয়া ওই ঘর এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গুদামঘর হিসেবে। আর বাড়ির সামনের বাগানটি এখন ইট-বালি-সিমেন্টের ভাগাড়। এলাকার অনেক বাসিন্দা জানেন না বাড়িটির ইতিহাস। বাড়ির দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়েছে বটগাছ। এলাকাবাসী নজরুলের স্মৃতি ধরে রাখতে দেয়ালে লিখেছে তার সেই গানটি—‘বাগিচায় বুলবুলি তুই...’। সেখানকার অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, সরকার বা নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে কবির এ স্মৃতিস্থান রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
নজরুল গবেষক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল হাই শিকদার জানান, ‘সদরঘাটের পূর্ব-উত্তর কর্নারে একসময় ছিল করোনেশন পার্ক। পার্কের জায়গায় এখন মার্কেট। পার্কের সেই মঞ্চ এখনও আছে—যে মঞ্চে বসে কবি গেয়েছেন অনেক গান।’ তবে এ মঞ্চও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বদলে যাচ্ছে। রমনা পার্কের বটতলায় বসে কবি ‘নিশি ভোর হলো’ গানটি লিখেছিলেন বলে জানান আবদুল হাই শিকদার। ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলেও আছে কবির স্মৃতি। ঢাকার নবাব পরিবারের এ বিখ্যাত ভবনে একবার কবিকে দেয়া হয়েছিল সংবর্ধনা। নবাব পরিবারের মেয়ে মেহের বানুর আঁকা ছবি দেখে কবি লিখেছিলেন ‘খেয়াপারের তরুণী’র মতো কলোত্তীর্ণ কবিতা। বনগ্রাম লেনের রানু সামের বাড়িটিও নজরুলের স্মৃতিধন্য। এ বাড়িতে তিনি তার এক ছাত্রীকে গান শেখাতেন। শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে একদিন অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র ছিল। কবি এখানে এসে গান গেয়েছিলেন।
তথ্যমতে, বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসে আছে নজরুলের অনেক দিনের স্মৃতি। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে তিনি প্রায় আড়াই সপ্তাহ ছিলেন। তখন প্রথমদিকে আবুল হোসেনের বাসায় উঠলেও পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবির বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাসা বর্ধমান হাউসে (১৯৫৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমী) ওঠেন। ক’মাস পর হঠাত্ করে বন্ধুদের সঙ্গে আবার আসেন। বর্ধমান হাউসে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ভবনের সামনের বটগাছের নিচে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল মঞ্চ। ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ ও ‘নজরুল মঞ্চ’ অব্যবস্থাপনা আর অযত্নের শিকার। স্মৃতিকক্ষ প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত দর্শকের জন্য খোলা থাকার কথা। অথচ সেটিও তালাবদ্ধ থাকে সব সময়। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে প্রতিষ্ঠিত ‘নজরুল কর্নার’-এরও একই অবস্থা। এখানে আছে কবির ব্যবহৃত অনেক জিনিস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির মাজার অবস্থিত। সুপারি গাছে ঘেরা ছোট্ট প্রাঙ্গণটি চিরতরের জন্য আপন করে নিয়েছেন তিনি। সেখানে ভেসে বেড়ায় আজানের সুর। কবরস্থানটি এখন বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। মাজার সংলগ্ন এলাকাটির সৌন্দর্য বাড়াতে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হয়। কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট এর উদ্বোধন হয়। ১৯৯৮ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠকে ওই কমপ্লেক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে আজও সেটি সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেও এখন পর্যন্ত সেটি কেন খোলা হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর অনেকের অজানা। কমপ্লেক্সে নজরুলের স্মৃতিস্মারক বিষয়ক তথ্যকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা থাকলেও আজও তা হয়নি। ঢাকার ফার্মগেটের পার্কটি থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম বের করেছিলেন ‘নজরুল র্যালি’। সেখানেও নেই এ বিষয়ক কোনো স্মৃতিফলক।
উল্লেখ্য, নজরুল প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন ১৯২৬ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে। তখন তিনি উঠেছিলেন পুরনো ঢাকার মোহিনী মোহন দাসের বাড়িতে। ওই বছরের অক্টোবরে তিনি আবার আসেন ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদস্য পদপ্রার্থী হয়ে ভোট চাইতে। সুস্থাবস্থায় নজরুল শেষবার ঢাকা এসেছিলেন ১৯৪০ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠানে। ১৯২৬ থেকে ’৪০ সালের মধ্যে নজরুল অনেকবার ঢাকায় এসেছেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ঢাকায় আসার সময় কবি ছিলেন অসুস্থ। ঢাকাতেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্টে কবির মৃত্যু হয়।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/05/20/145916
ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নানা স্মৃতিজড়িত স্থান। কোথাও বসে কবি লিখেছিলেন কালজয়ী গান, কোথাও লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা। কোথাও বসে তিনি গেয়েছিলেন নিজ কণ্ঠে গান। কোথাও কবি দিয়েছিলেন নির্বাচনী বক্তৃতা। আবার কোথাও কবিকে ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষীরা জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত সংবর্ধনা। কবির স্মৃতিজড়িত স্থানের মধ্যে কোমল ঘাসের পার্ক থেকে শুরু করে আছে স্থাপত্যশৈলী, ঐতিহ্যঘেরা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর। রাষ্ট্রের চরম অবহেলায় এসব স্থান নিশ্চিহ্ন হতে বসলেও অনেক স্থান এখনও টিকে আছে কবির প্রতি মানুষের প্রবল ভালোবাসার টানে। সরকার, রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এসব স্থান রক্ষায় এগিয়ে না এলেও কবির প্রতি শ্রদ্ধা থেকে মানুষ অনেক স্থানে লাগিয়েছেন স্মৃতিফলক। গবেষকদের দেয়া তথ্যমতে, ঢাকার নানা এলাকা মিলিয়ে নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থান আছে ৩১টি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে জাতীয় কবির স্মৃতিময় এসব স্থান রক্ষায় সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। সংরক্ষণের অভাবে বদলে যাচ্ছে অনেক স্থান। সরেজমিনে অধিকাংশ স্থানে স্মৃতিফলক পর্যন্ত চোখে পড়েনি। এসব স্থানে স্মৃতিফলক লাগাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কাছে নজরুল ইনস্টিটিউট ২০০৬ সালে আবেদন করে। এ আবেদনে ডিসিসি আজও সাড়া দেয়নি।
ঢাকার যে কোনো দিক থেকে ঘুরলে নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থান দেখা যায়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের বাড়িতে আছে কবি ভবন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ’৭৫-এর ২২ জুলাই পর্যন্ত কবি এ বাড়িতে ছিলেন। পরিকল্পনার অভাবে এ বাড়ি লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে গেছে। বাড়িটির সামনে যে বাগানে কবি হাঁটতেন, ঘুরতেন—সেখানে এখন গাড়ির গ্যারেজ। সেই বাগান আর নেই। তবে বাড়িটিতে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুলচর্চা বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। এর প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহর দেয়া তথ্যমতে, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেন। নজরুলের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখা, তার জীবন, সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার জন্য তিনি কবি ভবন নামে প্রকল্পটি নেন। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর প্রকল্পটি তিন-চার বছর বন্ধ ছিল। এরশাদ সরকার প্রকল্পটির নাম বদলে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প নামে অনুমোদন দেয়। ওই সরকারের খেয়াল-খুশিমতই সেটি বাস্তবায়িত হয়।’
পুরনো ঢাকার ৫২ বেচারাম দেউড়ির মৌলভি আবদুল হাসনাত সাহেবের বাড়িতে বসে নজরুল একবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। বাড়িটির সামনের বাগানে বসে কবি লেখেন তার বিখ্যাত গান ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘দোলনচাঁপার হিন্দোলে’ বইয়ে উল্লেখ আছে—‘বেচারাম দেউড়িতে নজরুলের ভক্ত ছিলেন পীর সৈয়দ মোহাম্মদ ইউসুফ। তার জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে কবি ঢাকার ওই বাড়িতে ছিলেন।’
জানা যায়, নজরুল ঢাকায় এলে এ বাড়িতে থাকতেন। তবে যে ঘরে তিনি থাকতেন সেটি এখন তালাবদ্ধ। টিন দিয়ে ছাওয়া ওই ঘর এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গুদামঘর হিসেবে। আর বাড়ির সামনের বাগানটি এখন ইট-বালি-সিমেন্টের ভাগাড়। এলাকার অনেক বাসিন্দা জানেন না বাড়িটির ইতিহাস। বাড়ির দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়েছে বটগাছ। এলাকাবাসী নজরুলের স্মৃতি ধরে রাখতে দেয়ালে লিখেছে তার সেই গানটি—‘বাগিচায় বুলবুলি তুই...’। সেখানকার অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, সরকার বা নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে কবির এ স্মৃতিস্থান রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
নজরুল গবেষক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল হাই শিকদার জানান, ‘সদরঘাটের পূর্ব-উত্তর কর্নারে একসময় ছিল করোনেশন পার্ক। পার্কের জায়গায় এখন মার্কেট। পার্কের সেই মঞ্চ এখনও আছে—যে মঞ্চে বসে কবি গেয়েছেন অনেক গান।’ তবে এ মঞ্চও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বদলে যাচ্ছে। রমনা পার্কের বটতলায় বসে কবি ‘নিশি ভোর হলো’ গানটি লিখেছিলেন বলে জানান আবদুল হাই শিকদার। ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলেও আছে কবির স্মৃতি। ঢাকার নবাব পরিবারের এ বিখ্যাত ভবনে একবার কবিকে দেয়া হয়েছিল সংবর্ধনা। নবাব পরিবারের মেয়ে মেহের বানুর আঁকা ছবি দেখে কবি লিখেছিলেন ‘খেয়াপারের তরুণী’র মতো কলোত্তীর্ণ কবিতা। বনগ্রাম লেনের রানু সামের বাড়িটিও নজরুলের স্মৃতিধন্য। এ বাড়িতে তিনি তার এক ছাত্রীকে গান শেখাতেন। শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে একদিন অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র ছিল। কবি এখানে এসে গান গেয়েছিলেন।
তথ্যমতে, বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসে আছে নজরুলের অনেক দিনের স্মৃতি। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে তিনি প্রায় আড়াই সপ্তাহ ছিলেন। তখন প্রথমদিকে আবুল হোসেনের বাসায় উঠলেও পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবির বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাসা বর্ধমান হাউসে (১৯৫৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমী) ওঠেন। ক’মাস পর হঠাত্ করে বন্ধুদের সঙ্গে আবার আসেন। বর্ধমান হাউসে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ভবনের সামনের বটগাছের নিচে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল মঞ্চ। ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ ও ‘নজরুল মঞ্চ’ অব্যবস্থাপনা আর অযত্নের শিকার। স্মৃতিকক্ষ প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত দর্শকের জন্য খোলা থাকার কথা। অথচ সেটিও তালাবদ্ধ থাকে সব সময়। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে প্রতিষ্ঠিত ‘নজরুল কর্নার’-এরও একই অবস্থা। এখানে আছে কবির ব্যবহৃত অনেক জিনিস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির মাজার অবস্থিত। সুপারি গাছে ঘেরা ছোট্ট প্রাঙ্গণটি চিরতরের জন্য আপন করে নিয়েছেন তিনি। সেখানে ভেসে বেড়ায় আজানের সুর। কবরস্থানটি এখন বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। মাজার সংলগ্ন এলাকাটির সৌন্দর্য বাড়াতে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হয়। কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট এর উদ্বোধন হয়। ১৯৯৮ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠকে ওই কমপ্লেক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে আজও সেটি সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেও এখন পর্যন্ত সেটি কেন খোলা হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর অনেকের অজানা। কমপ্লেক্সে নজরুলের স্মৃতিস্মারক বিষয়ক তথ্যকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা থাকলেও আজও তা হয়নি। ঢাকার ফার্মগেটের পার্কটি থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম বের করেছিলেন ‘নজরুল র্যালি’। সেখানেও নেই এ বিষয়ক কোনো স্মৃতিফলক।
উল্লেখ্য, নজরুল প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন ১৯২৬ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে। তখন তিনি উঠেছিলেন পুরনো ঢাকার মোহিনী মোহন দাসের বাড়িতে। ওই বছরের অক্টোবরে তিনি আবার আসেন ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদস্য পদপ্রার্থী হয়ে ভোট চাইতে। সুস্থাবস্থায় নজরুল শেষবার ঢাকা এসেছিলেন ১৯৪০ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠানে। ১৯২৬ থেকে ’৪০ সালের মধ্যে নজরুল অনেকবার ঢাকায় এসেছেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ঢাকায় আসার সময় কবি ছিলেন অসুস্থ। ঢাকাতেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্টে কবির মৃত্যু হয়।
Subscribe to:
Posts (Atom)