যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -

Wednesday 23 May 2012

‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন ‘অজর অমর`

‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন ‘অজর অমর’:আহমদ বাসির



আর কোন্ মোহন বাঁশিতে ফুঁক দেয়া বাকি ছিল তাঁর? আর কোন্ কথা বলা বাকি ছিল তাঁর? হয়তো অনেক কথাই বলা হয়নি তাঁর! হয়তো অনেক বাঁশিই ছোঁয়া হয়নি তাঁর! তবু যত সুরে তিনি বাজিয়েছেন তাঁর অন্তরের আকাঙ্ক্ষা, যত উচ্চারণে উচ্চকিত করেছেন নিজ-সত্তাকে—তার কতটুকুই বা ধরতে পেরেছে আজও এই বৃহত্ বঙ্গের মানুষ। তার রুদ্র-রূপ আমাদের এই মহা-ক্ষুদ্রতাকে আজও অবিরাম লজ্জা দিয়ে যায়। কোথায় সে বীর, যার শির দেখে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া নত হয়ে গেল!
চির যৌবনের কবি, চির তারুণ্যের কবি, চির নবীনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিস্ময় হয়ে জন্মেছিলেন এই বঙ্গে। বিশ শতকের বিশ্ব তাঁকে চেনেনি, একুশ শতকের বিশ্ব কি চিনে নেবে সেই বিস্ময়কে, যখন তাঁর ভাষা যারা বোঝে তারাও চিনতে পারেনি তাঁকে। তাই তিনি আজও ‘কবর সবর করিয়া’ আছেন—সেই যৌবনের প্রতীক্ষায়, সেই তারুণ্যের প্রতীক্ষায়, সেই নবীনের প্রতীক্ষায়—যারা তাজ-ব-তাজার গাহিয়া গান, সজীব করিবে মহাশ্মশান।
নজরুল কবরে বসেও দেখতে পান তারুণ্যের দুর্দশা, যে তারুণ্য অসাম্য ও কুিসতকে ধ্বংস করে পরম সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন এই পৃথিবীকে ‘অজর অমর’ করে রাখবে—তাই ‘অভয়-সুন্দর’ কবিতায় নজরুলের উচ্চারণ—
কুিসত যাহা, অসাম্য যাহা সুন্দর ধরণীতে
হে পরম সুন্দরের পূজারী! হবে তাহা বিনাশিতে।
তব প্রোজ্জ্বল প্রাণের বহ্নি-শিখায় দহিতে তারে
যৌবন ঐশ্বর্য শক্তি লয়ে আসে বারে বারে।
যৌবনের এ ধর্ম, বন্ধু, সংহার করি জরা
অজর অমর করিয়া রাখে এ প্রাচীনা বসুন্ধরা।
যৌবনের এ ধর্ম হারায়ে বিধর্মী তরুণেরা—
হেরিতেছি আজ ভারতে—রয়েছে জরার শকুনে ঘেরা।
পাঠক অনায়াসে ‘ভারত’ শব্দের স্থলে ‘এদেশে’ পড়ে নিতে পারেন কিংবা ‘বিশ্বে’। সমগ্র পৃথিবী এখন ‘লোভী ও ভোগী’দের দখলে। নজরুল বিশ্বমানবতার কবি। তিনি ধর্মের কবি। সব অর্ধমই তাঁর পায়ের তলে মূর্ছিত হয়ে যায়। সব ধর্মের মর্ম-চেতনাই তাঁর মর্মমূলে একাকার হয়ে যায়। জাতীয়তাবোধে জারিত নজরুলের জীবন-দর্শন মূলত বৈশ্বিক। ধর্মহীন লোভী ও ভোগীদের প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রতিষ্ঠা-কাম্য এক বিশ্ব-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নজরুল ধর্মীয়-চেতনায় জারিত এক বিকল্প বিশ্ব-ব্যবস্থার কথা বলেন, যেখানে সুন্দরের (এক আল্লাহ) পূজা-অর্চনা তথা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য। তাই ‘লোভী ও ভোগী’দের এই সভ্যতার মূলে আঘাত করেন নজরুল কঠোর হস্তে। আর বিদ্রূপ করেন তরুণদের— যে তরুণেরা যৌবনের ধর্ম হারায়ে বিধর্মী হয়ে গেছে, ‘লোভী ও ভোগী’দের ফাঁদে পা দিয়ে ‘জরার শকুনে’ ঘেরাও হয়ে আছে।
এ কবিতায় নজরুল এই জরাগ্রস্ত সভ্যতার এক অপূর্ব চিত্র আমাদের মানসপাটে গেঁথে দিয়েছেন। এই চিত্র-নির্মাণে তিনি হিন্দু-পুরাণের এক ভোগবাদী রাজাকে হাজির করেছেন। এর নাম ‘যযাতি’। এই ‘যযাতি’ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অভিশাপে তার আপন যৌবন হারিয়েছে। আপন বিলাস ভোগের জন্য সে তার পুত্রের কাছে পুত্রের যৌবন যাচনা করেছে। তার কনিষ্ঠ পুত্র পিতার জরা গ্রহণ করে নিজ যৌবন পিতাকে দিয়েছে। ‘যযাতি’ পুত্রের যৌবন গ্রহণ করে আবার ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত সে হাস্যকর চিত্র, যা দেখে ভোগবাদীরা পরমানন্দে হাসে, আর ‘সত্য পথের তীর্থ পথিক’ পরম সুন্দরের পূজারীরা আঁখি-জলে ভাসে—
যৌবনে করি বাহন তাহার জরা চলে রাজ-পথে
হাসিছে বৃদ্ধ যুবক সাজিয়া যৌবন-শক্তি-রথে
জ্ঞান-বৃদ্ধের দন্তবিহীন বৈদান্তিক হাসি
দেখিছ তোমরা পরমানন্দে—আমি আঁঁখি-জলে ভাসি
বলা হয়ে থাকে, যৌবনের ইবাদত আল্লাহর কাছে বেশি কবুলযোগ্য। যৌবনের ইবাদত মানেই পরম সুন্দরের পূজা আর জরার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই। নজরুল এই সংজ্ঞার্থ ‘অভয়-সুন্দর’ কবিতার শুরুতেই উল্লেখ করেছেন। এ কবিতায় নজরুল তার স্বীয় জীবন-দর্শনের মূল তত্ত্ব আবারও উচ্চারণ করেছেন। এই তত্ত্বের মূলে আছে প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধন। যৌবন আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় যে, যারা বেহেশতে ঠাঁই পাবে তারা তাদের যৌবন নিয়েই সেখানে বসবাস করবে। নজরুল তাঁর অন্য একটি কবিতায় এ প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন। যে যৌবন আল্লাহর কাছে সমর্পিত অর্থাত্ পরম সুন্দরের পূজারী, সে যৌবন আল্লাহর শক্তিতে বলীয়ান। তাই যৌবন শক্তিকে যারা ভোগের বাহন বানায়, সেসব তরুণের প্রতি নজরুলের করুণামাখা উচ্চারণ—
মহাশক্তির প্রসাদ পাইয়া চিনিলে না হায় তারে
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া ফিরিতেছ দ্বারে দ্বারে।
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া দ্বারে দ্বারে ঘোরার এই দৃশ্যকল্পটিও নির্মম হাস্যকর, যে শিবকে নজরুল এ কবিতার অন্য একটি পঙিক্ততে বলেছেন ‘ভোলানাথ শিব মহারুদ্র’। যারা এ নির্মম দৃশ্যকল্প নির্মাণ করে, তাদের প্রতি নজরুলের তাই পরিণামদর্শী উচ্চারণ—
পেয়ে ভগবদ্-শক্তি যাহারা চিনিতে পারে না তারে
তাহাদের গতি চিরদিন ঐ তমসার কারাগারে।
এই তরুণদের তিনি ‘হস্তী-মূর্খ’ বলেও গাল দিয়েছেন—
ঐরাবতেরে চালায় মাহুত শুধু বুদ্ধির ছলে—
হে তরুণ, তুমি জানো কী ‘হস্তী-মূর্খ’ কাহারে বলে?
অপরিমাণ শক্তি লইয়া ভাবিছ শক্তি-হীন—
জরারে সেবিয়া লভিতেছ জরা, হইতেছ আয়ু-ক্ষীণ।
তারুণ্যের এই অধঃপতনের জন্য নজরুল ‘ধূর্ত বুদ্ধি-জীবী’ ও রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। ধূর্ত বুদ্ধিজীবীরা তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করে। সঠিক পথ প্রদর্শনের পরিবর্তে তাদের ‘ভোগী ও লোভী’দের নৌকায় তুলে দেয়। আর রাজনীতিকরা এদের হাতে তুলে দেয় ভোট-ভিক্ষার ঝুলি। ফলে পরম সুন্দরের কাছে, পরম করুণাময়ের কাছে শক্তি-ভিক্ষার পরিবর্তে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করে মূলত জরার সেবকে পরিণত হয়। তাই নজরুলের প্রশ্নবোধক উচ্চারণ—
ধূর্ত বুদ্ধি-জীবীর কাছে কি শক্তি মানিবে হার?
ক্ষুদ্রে রুধিবে ভোলানাথ শিব মহারুদ্রের দ্বার?
নজরুলের কাছে যৌবন হচ্ছে সূর্যের আলোর মতো। প্রচলিত রাজনীতি সেই যৌবন শক্তির সূর্যালোককে উনুনে পরিণত করে।
নজরুলের ভাষায়—
শক্তি ভিক্ষা করিবে যাহারা ভোট-ভিক্ষুক তারা!
চেনো কি—সূর্য-জ্যোতিরে লইয়া উনুন করেছে যারা?
এই ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, ‘ক্ষুদ্র’ও বটে, আর রাজনীতিক এদেশে ‘কচুরিপানা’র মতোই বিস্তারিত হয়েছে বিস্তর। এদের ঘেরাটোপের মধ্যে পুরোপুরি বন্দি হয়ে পড়েছে এদেশের যুব শক্তি। এই কচুরিপানা ধ্বংস করে দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন নজরুল তাঁর ‘কচুরিপানা’ নামের একটি গানে। তিনি বলেছেন, এদের যদি ধ্বংস করা না হয়, তাহলে এরাই আমাদের ধ্বংস করে ছাড়বে। পরিস্থিতি এখন সেই পরিসর দখল করে নিয়েছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে দেশ—কচুরিপানা ধ্বংস না করার পরিণতি। নজরুল এই কচুরিপানার স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন—
(এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুর ছানা\
ইহাদের সবংশে কর কর নাশ,
এদের দগ্ধ করে কর ছাই পাঁশ
(এরা) জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস
-----------------------
(কাল) সাপের ফণা এরা পাতায় পাতায়,
(এরা) রক্তবীজের ঝাড়, মরিতে না চায়
(ভাই) এরা না মরিলে মোরা মরিব সবাই
(এরে) নির্মূল করে ফেল, শুন না মানা
ধ্বংস কর এই কচুরিপানা\

আর যারা মানবিক-সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে কেবল শিল্পের জন্য শিল্প চর্চায় নিবিষ্ট রয়েছে, তাদের সম্পর্কে নজরুল ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ কবিতায় বলেছেন—
ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি
তোমরা দেখেছ ঊর্ধ্বের শশী, রবি!
তোমরা তাঁহার সুন্দর সৃষ্টিরে,
রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে।
তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপ-মালা
করে না ক কেন কাঙালের ঘর আলা?
এত জ্ঞান এত শক্তি বিলাস সে কি?
আলো তার দূর কুটিরে যায় না কোন্ সে শিলায় ঠেকি?
মহান আল্লাহর সৃষ্টি জগত্ নিয়েই এরা রস রচনা করে। অথচ এরা আল্লাহকে ভুলে, আল্লাহর সৃষ্টির সেবা ভুলে জ্ঞান আর শিল্পশক্তির বিলাসে মত্ত। এদের সম্পর্কে নজরুলের শেষ সিদ্ধান্ত—
যাহারা বুদ্ধিজীবী, সৈনিক হবে না তাহারা কভু,
তারা কল্যাণ আনেনি কখনো, তারা বুদ্ধির প্রভু।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এই ধূর্ত-বুদ্ধিজীবীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে মানা করে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এরা বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় এবং যা বলে তা তারা করে না। মহামতি ‘প্লেটো’ তার ‘রিপাবলিক’ থেকে এদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন প্রায় একই কারণে। দ্বিধাহীন নজরুলের অভিধানে এরা তাই ‘বুদ্ধির প্রভু’, ‘ধূর্ত বুদ্ধি-জীবী’। এরা কখনোই কল্যাণ আনতে পারে না। কেননা, এদের কোনো ধর্ম নেই, এরা অধর্মের দোসর। লোভ এবং ভোগের শিলা এদের জ্ঞানের আলোকে ঠেকিয়ে রাখে। এদের জ্ঞানের আলো কেবল তখত্-লোভী অসুর দলের প্রাসাদকেই আলোকিত করে রাখে। আজকের বাংলাদেশে এদের আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না—এরা এতই দৃশ্যমান। অন্যদিকে, রাজনীতিকরা যখন ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে তারুণ্যের অপরিসীম শক্তিকে দাস বানিয়ে দেয় আর চাকরিলোভী তরুণেরা সেই মোহে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন নজরুল ওইসব তরুণকে উদ্দেশ করে বলেন—
চাকুরি করিয়া পিতামাদের সুখী করিতে কি চাহ?
তাই হইয়াছ নুড়ো মুখ যত বুড়োর তলিপ বাহ?
চাকর হইয়া বংশের তুমি করিবে মুখোজ্জ্বল?
অন্তরে পেয়ে অমৃত, অন্ধ, মাগিতেছ হলাহল!
আর যারা তখত্-লোভীদের চাকরে পরিণত হয়েছে তাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন—
হউক সে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কি মন্ত্রী কমিশনার—
স্বর্ণের গলা-বন্ধ পরুক—সারমেয় নাম তার!
দাস হইবার সাধনা যাহার নহে সে তরুণ নহে—
যৌবন শুধু মুখোশ তাহার—ভিতরে জরারে বহে।
‘সারমেয়’ শব্দের অর্থ যে ‘কুকুর’, এ তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার অবকাশ রয়ে গেছে। ‘নাকের বদলে নরুন’ চাওয়া এসব তরুণকে প্রত্যাখ্যান করে নজরুল আজাদ মুক্ত-স্বাধীন চিত্ত যুবাদের জয়গান গেয়ে চলেন। যেসব তরুণ পথের ভিখারি হতে রাজি তবু ‘সুবিধা-শিকারি’ হতে রাজি নয়, তাদেরই জয়গাথা চিরদিন গেয়ে বেড়ান নজরুল। তাদেরই তিনি করজোড়ে প্রণাম জানান, তাদের জন্যই তিনি মহাভিক্ষু সেজে তপস্যা করেন, তাদের জন্যই তিনি নিশিদিন ‘বাজো রে শিঙ্গা বাজো!’ মন্ত্র হেঁকে বেড়ান। তিনি বলেন—
সমাধির গিরি-গহ্বরে বসি তাহাদেরই পথ চাহি—
তাদেরই আভাস পেলে মনে হয় পাইলাম বাদশাহি!
মোর সমাধির পাশে এলে কেউ, ঢেউ ওঠে মোর বুকে—
‘মোর চির-চাওয়া বন্ধু এলে কি’ বলে চাহি তার মুখে।
জ্যোতি আছে, হায় গতি নাই হেরি তার মুখ পানে চেয়ে—
কবরে ‘সবর’ করিয়া আমার দিন যায় গান গেয়ে।
কারে চাই আমি কী যে চাই হায় বুঝে না উহারা কেহ।
দেহ দিতে চায় দেশের লাগিয়া, মন টানে তার গেহ।
নজরুলের কবরের কাছে যারা নিত্য আসা-যাওয়া করে, জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে কিংবা ভক্তি জানাতে অন্য কোনো দিনে—তাদেরও নজরুল প্রত্যাখ্যান করেন। তারা নজরুল-ভক্ত বটে, তবে আত্মশক্তিহীন। এদের মনে এখনও পার্থিব খায়েশ। এরা মুখে মুখে শহীদ হতে চায় কিন্তু অন্তর তাদের গৃহে বাঁধা। এরা ভীরু। নজরুল দেখতে পান এদের বুকে ভয়ের ছায়া—
আঁধারে থাকিয়া, বন্ধু, দিব্য দৃষ্টি গিয়াছে খুলে
আমি দেখিয়াছি তোমাদের বুকে ভয়ের যে ছায়া দুলে!
তোমরা ভাবিছ—আমি বাহিরিলে তোমরা ছুটিবে পিছে—
আপনাতে নাই বিশ্বাস যার—তাহার ভরসা মিছে!
নজরুল আত্মশক্তিতে বলীয়ান সেই তারুণ্যের আগমনের অপেক্ষায় ‘শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া’ ‘প্রতীক্ষারত’, যারা তাদের সেনাপতি শহীদ হয়ে যাওয়ার পরও সম্মুখসমরে অটল থেকে লড়তে থাকে। তিনি বলেন—
আমি যদি মরি সমুখ-সমরে—তবু যারা টলিবে না—
যুঝিবে আত্মশক্তির বলে তারাই অমর সেনা।
সেই সেনা দল সৃষ্টি যেদিন হইবে—সেদিন ভোরে
মোমের প্রদীপ নহে গো—অরুণ সূর্য দেখিব গোরে।
............
ভয়কে যাহারা ভুলিয়াছে—সেই অভয় তরুণ দল
আসিবে যেদিন—হাঁকিব সেদিন—‘সময় হয়েছে, চল্!’
এই অভয় তরুণ দলের কোনো পিছুটান থাকতে পারে না, স্নেহ-ভালোবাসার নীড়ও এদের কর্তব্যবিমুখ করতে পারে না। এজন্যই নজরুল বলেন—
কোথা গৃহ-হারা, স্নেহ-হারা ওরে ছন্নছাড়ার দল—
যাদের কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে টলমল।
পিছন চাওয়ার নাহি যার কেহ, নাই পিতামাতা জ্ঞাতি
তারা তো আসে না জ্বালাইতে মোর আঁধার কবরে বাতি।
নজরুল মজলুমের পরম-বন্ধু। অথচ নজরুলের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ঘটছে না। যারা দিনরাত নজরুল নিয়ে মাতামাতি করে, তারা তো সেই মজলুমদের কেউ নয়। বরং এরা সংসার-সুখের মায়ায় জড়িয়ে রেখে নিজেদের শক্তিকে অবিরাম অপমান করে চলেছে। নিজেরা সুখের জন্য বেকারার, কিন্তু অসুখী মজলুমের যে কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে, সে কাঁদন এরা শুনতে পায় না। এরা লক্ষ টাকার শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে গান গায়—
‘তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহেলিল্লাহ্’।
সুতরাং মজলুমের ডাকে যারা সব পিছুটান-শৃঙ্খল ছিঁড়ে সুখ-শয্যা ত্যাগ করে ছুটে যায়, তারাই নজরুলের অভিধানে ‘অমর সেনা’। এই অমর সেনাদলের জন্যই নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন। নজরুল এই আত্মশক্তিতে বলীয়ান সেনাদলের হাতেই নিজের পতাকা তুলে দিতে চান। এদের সিপাহসালার হওয়াই তাঁর চিরকালের সাধনা। অতএব তিনি বলেন—
আমি গেলে যারা আমার পতাকা ধরিবে বিপুল বলে—
সেই সে অগ্র-পথিকের দল এস এস পথ-তলে!
সেদিন মৌন সমাধি-মগ্ন ইসরাফিলের বাঁশি
বাজিয়া উঠিবে—টুটিবে দেশের তমসা সর্বনাশী!
এদেশের বুক থেকে ‘তমসা সর্বনাশী’কে বিদায় করতে হলে সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি করতে হবে, যারা নজরুলের পতাকা ‘ধরিবে বিপুল বলে’। এই ‘আজাদ মুক্ত-স্বাধীন চিত্ত’ সেনাদল কে সৃষ্টি করবে? যারা আধিপত্যকামী, তারা? যারা ফ্যাসিবাদী, তারা? যারা ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, তারা? যারা লোভী-ভোগী, তারা? অসম্ভব, এদের হাতে কখনোই সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি হবে না। তাই ‘অজর অমর’ নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন, ‘শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া’ প্রতীক্ষা করে আছেন ভগবত্-শক্তিতে শক্তিমান, আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান সেই তরুণদের; যারা আপনিই আপনাকে সৃষ্টি করবে, ঐশী শক্তির কৃপা ভিক্ষা করে যারা নিজেরাই ঐশী শক্তির আধার হয়ে উঠবে—তারা অমর, তারা অজর, তারা অবিনাশী, তারা পুরুষোত্তম সত্য।

No comments:

Post a Comment