যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -

Sunday 20 November 2011

গুল-বাগিচার বুলবুলি

গুল-বাগিচার বুলবুলি আমি
রঙিন প্রেমের গাই গজল (হায়)
অনুরাগের লাল শারাব মোর
চক্ষে ঝলে ঝলমল (হায়)।

আমার গানের মদির ছোঁয়ায়
গোলাপ কুঁড়ির ঘুম টুটে যায়
সে গান শুনে প্রেম-দীওয়ানা
কবির আঁখি ছলছল (হায়)।

লাল শিরাজীর গেলাস হাতে
তন্নী সাকী পড়ে ঢুলে
আমার গানের মিঠা পানির
লহর বহে নহর-কুলে।
ফুটে ওঠে আনারকলি
নাচে ভ্রমর রং-পাগল (হায়)।

সে সুর শুনে দিশেহারা
ঝিমায় গগন ঝিমায় তারা
চন্দ্র জাগে তন্দ্রাহারা
বনের চোখে শিশির-জল (হায়)।।

যাও মেঘদূত, দিও প্রিয়ার হাতে

যাও মেঘদূত,
দিও প্রিয়ার হাতে
আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া পাতে।
আমার প্রিয়ার দীর্ঘ নিশাসে
থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশেরই আকাশে
আমার প্রিয়ার ম্লান মুখ হেরি
ওঠে না চাঁদ আর যে দেশে রাতে
পাইবে যে দেশে কুন্তল-সুরভি বকুল ফুলে
আমার প্রিয়া কাঁদে এলায়ে কেশ সেই মেঘনা কুলে
স্বর্ণলতার সম যার ক্ষীণ করে
বারে বারে কঙ্কণ-চুড়ি খুলে পড়ে
মুকুল-বাসে যথা বরষার ফুলদল
বেদনায় মূর্চ্ছিয়া আছে আঙিনাতে।।

নিশি ভোর হল জাগিয়া

নিশি ভোর হল জাগিয়া, পরাণ পিয়া
ডাকে পিউ কাঁহা পাপিয়া, পরাণ পিয়া।
ভুলি বুলবুলি সোহাগে, কত গুলবদনী জাগে
রাতি গুলশনে যাপিয়া, পরাণ পিয়া।

জেগে রয় জাগার সাথী
দূরে চাঁদ, শিয়রে বাতি
কাঁদি ফুলশয়ন পাতিয়া
পরাণ পিয়া।

গেয়ে গান কে কাহারে
জেগে রয় কবি এ পারে
দিলি দান কারে এ হিয়া
পরাণ পিয়া।।

তোমারেই আমি চাহিয়াছি প্রিয়

তোমারেই আমি চাহিয়াছি প্রিয় শতরূপে শতবার
জনমে জনমে তাই চলে মোর অনন্ত অভিসার।
বনে তুমি যবে ছিলে বনফুল
গেয়েছিনু গান আমি বুলবুল
ছিলাম তোমার পূজার থালায় চন্দন ফুলহার।

তব সংগীতে আমি ছিনু সুর, নৃত্যে নূপুরছন্দ
আমি ছিনু তব অমরাবতীতে পারিজাত ফুলগন্ধ।
কত বসন্তে কত বরষায়
খুঁজেছি তোমায় তারায় তারায়
আজিও এসেছি তেমনই আশায় লয়ে স্মৃতি সম্ভার।।

কত যুগ যেন দেখিনি তোমার

কত যুগ যেন দেখিনি তোমারে, দেখি নাই কতদিন
তুমি যে জীবন, তোমারে হারায়ে হয়েছিনু প্রাণহীন।
তুমি যেন বায়ু; বায়ু যবে নাহি বয়
আমি ঢুলে পড়ি আয়ু মোর নাহি রয়
তুমি যেন জল, বাঁচিতে পারিনা জল বিনা আমি মীন।
তুমি জানোনা গো তব আশ্রয় বিনা
আমি কত অসহায়
তুমি না ধরিলে আমার এ তনু বাতাসে মিশায়ে যায়।
তাই মোর দেহ লতার প্রায়
তোমারেই শুধু জড়াইতে চায়
তাই এ বিরহী তনু মোর হের
দিনে দিনে হয় ক্ষীণ।।

বুকে তোমায় নাইবা পেলাম

বুকে তোমায় নাইবা পেলাম রইবে আমার চোখের জলে
ওগো বধুঁ! তোমার আসন, গভীর ব্যথায় হিয়ার তলে
আসবে যখন তিমির রাতি রইবেনা কেউ জাগার সাথি
আসবে সেদিন জ্বালব বাতি, মুছব নয়ন জল আঁচলে
নাইবা হলাম প্রিয় তোমার, বন্ধু হতে দোষ কি বধুঁ
মুখের মধুর তৃষ্ণা শেষে আমি দিব বুকের মধু
আমি ভালবাসিনি ত' ভালবাসা পাবার ছলে
বাহুর পাশে প্রিয়ায় বেঁধে আমার তরে উঠবে কেঁদে
সেইতো আমার প্রিয় জয় গো,
প্রিয়, অন্তরে রই, রইনা গলে

Saturday 19 November 2011

শিউলি মালা গেঁথে ছিলাম তোমায় দেবো বলে

শিউলি মালা গেঁথে ছিলাম তোমায় দেবো বলে
না নিয়ে সে মালা নিঠুর তুমি গেলে চলে
প্রনাম করে উদ্দেসে তাই সেই মালিকা জলে ভাসাই
তোমার ঘাটে লাগে যদি নিও চরন তলে
এল শুভদিন যবে মোর দুখের রাতির শেষে
তোমার তরি গেল ভেসে সুদুর নিরুদ্দেশে
দিন ফুরাবে শিউলি ফুটার
মোর শুভদিন আসবেনা আর
ভরল বিফল পুজার থালা
নীরব চোখের জলে।।

গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙ্গে যায়

গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায়
কে যেন আমারে ডাকে
সে কি তুমি, সে কি তুমি?

কার স্মৃতি বুকে পাষাণের মত ভার হয়ে যেন থাকে
সে কি তুমি, সে কি তুমি?

কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন হায়
ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায়
কার সকরুণ আঁখি দুটি যেন রাতের তারার মত
মুখপানে চেয়ে থাকে
সে কি তুমি, সে কি তুমি?

নিশির বাতাস কাহার হুতাশ দীরঘ নিশাস সম
ঝড় তোলে এসে অন্তরে মোর, ওগো দুরন্ত মম
সে কি তুমি, সে কি তুমি?

মহাসাগরের ঢেউয়ের মতন
বুকে এসে বাজে কাহার রোদন?
পিয়া পিয়া নাম ডাকে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি
আমার চম্পা শাখে
সে কি তুমি, সে কি তুমি?

বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে

বুল্‌বুলি নীরব নার্গিস বনে
ঝরা বনগোলাপের বিলাপ শোনে।
শিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধির পাশে
তরুণ ইরাণ-কবি কাঁদে নির্জনে।

উদাসীন আকাশ থির হয়ে আছে
জল-ভরা মেঘ লয়ে বুকের কাছে
সাকীর শরাবের পেয়ালার পরে
সকরুণ অশ্রুর বেল ফুল ঝরে
চেয়ে আছে ভাঙা চাঁদ মলিন-আননে।।

চোখের নেশার ভালবাসা সে কি কভু থাকে গো

চোখের নেশার ভালবাসা সে কি কভু থাকে গো
জাগিয়া স্বপনের স্মৃতি স্মরণে কে রাখে গো?
তোমরা ভোল গো যারে, চির-তরে ভোল তারে
মেঘ গেলে ছায়া আবছায়া থাকে কি আকাশে গো?
পুতুল লইয়া খেলা খেলিছ বালিকা বেলা
খেলিছ পরাণ লয়ে তেমনি পুতুল খেলা
ভাঙ্গিছ গড়িছ নিতি হৃদয়-দেবতাকে গো।
চোখের ভালোবাসা গলে শেষ হয়ে যায় চোখের জলে
বুকের ছলনা সে কি আঁখিজলে ঢাকে গো?

Friday 18 November 2011

আমি ময়নামতীর শাড়ি দেব

আমি ময়নামতীর শাড়ি দেব, চল আমার বাড়ি
তোরে সোনাল ফুলের বাজু দেবো, চুড়ি বেলোয়ারী
তোরে বৈঁচী ফুলের পৈঁচী দেবো, কল্‌মিলতার বালা
গলায় দেবো টাট্‌কা তোলা ভাঁট ফুলেরই মালা
রক্ত-শালুক দিব পায়ে, পরবে আল্‌তা তারি।

হলুদ-চাঁপার বরণ কন্যা এস আমার নায়
সরষে ফুলের সোনার রেণু মাখাব ওই গায়
ঠোঁটে দিব রাঙা পলাশ, মহুয়া ফুলের মউ
বকুল ডালে দাকবে পাখি, বউ গো কথা কও
আমি সব দিব গো, যা পারি আর যা না দিতে পারি।।

আমার নয়নে নয়ন রাখি

আমার নয়নে নয়ন রাখি
পান করিতে চাহ কোন অমিয়
আছে এ আঁখিতে উষ্ণ আঁখিজল
মধুর সুধা নাই পরাণ প্রিয়।

ওগো ও শিল্পী গলাইয়া মোরে
গড়িতে চাহ কোন মানস প্রতিমারে
ওগো ও পূজারী কেন এ আরতি
জাগাতে পাষাণ প্রণয় দেবতারে
এ দেহ ভৃঙ্গারে থাকে যদি মদ
ওগো প্রেমাস্পদ পিও হে পিও।

আমারে কর গুণী তোমার বীণা
কাঁদিব সুরে সুরে কণ্ঠলীনা
আমার মনের মুকুরে কবি
হেরিতে চাহ কোন মানসীর ছবি
চাহ যদি মোরে কর গো চন্দন
তপ্ত তনু তব শীতল করিয়ো।।

আমার আপনার চেয়ে আপন

আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি পিয়াসী বাসনায়।

আমার মনের তৃষিত আকাশে
ফেরে সে চাতক আকুল পিয়াসে
কভু সে চকোর সুধাচোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়।

আমার মনের পিয়াল তমালে
হেরি তারে স্নেহ মেঘশ্যাম
অশনি আলোতে হেরি তারে থির
বিজুলি উজল অভিরাম।

আমারি রচিত কাননে বসিয়া
পরাণ প্রিয়ারে মালিকা রচিয়া
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া
আপনারই গলে দোলে হায়।।

অনেক কথা বলার মাঝে

অনেক কথা বলার মাঝে
লুকিয়ে আছে একটি কথা।
বলতে নারি সেই কথাটি
তাই এ মুখর ব্যাকুলতা।।
সেই কথাটি ঢাকার ছলে
অনেক কথা যাই গো ব’লে
ভাসি আমি নয়ন-জলে
বল্‌তে গিয়ে সেই বারতা।।
অবকাশ দেবে কবে
কবে সাহস পাব প্রাণে
লজ্জা ভুলে সেই কথাটি
বল্‌ব তোমায় কানে কানে।
মনের বনে অনুরাগে
কত কথার মুকুল জাগে
সেই মুকুলে বুকে জাগাও
ফুটে উঠার ব্যাকুলতা।।

আধো-আধো বোল

আধো-আধো বোল, লাজে বাধো-বাধো বোল
ব’লো কানে কানে
যে কথাটি আধো রাতে মনে জাগায় দোল
ব’লো কানে কানে।

যে কথার কলি সখি আজও ফুটিল না
শরমে মরম-পাতে দোলে আন্‌মনা
যে কথাটি ঢেকে রাখে বুকের আঁচল
ব’লো কানে কানে।

যে কথা লুকায়ে রাখ লাজ নত চোখে
না বলিতে যে কথাটি জানাজানি লোকে
যে কথাটি ধরে রাখে অধরের কোল
ব’লো কানে কানে।

যে কথা বলিতে চাহ বেশভূষার ছলে
যে কথা দেয় বলে তব তনু পলে পলে
যে কথাটি বলিতে সই গালে পড়ে টোল
ব’লো কানে কানে।।

ব্রজ গোপী খেলে হরি

ব্রজ গোপী খেলে হরি
খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সাথে।
রাঙা অধরে ঝরে হাসির কুম্‌কুম্‌
অনুরাগ-আবীর নয়ন-পাতে।
পিরীতি-ফাগ মাখা গৌরীর সঙ্গে
হরি খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে।
বসন্তে এ কোন কিশোর দুরন্ত
রাধারে যে নিতে এলো পিচকারী হাতে।।
গোপীনীরা হানে অপাঙ্গ খর শর
ভ্রুকুটি ভঙ্গ অনঙ্গ আবেশে
জর জর থর থর শ্যামের অঙ্গ।
শ্যামল তনুতে হরিত কুঞ্জে
অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে
রঙ-পিয়াসী মন ভ্রমর গুঞ্জে
ঢালো আরো ঢালো রঙ
প্রেম-যমুনাতে।।

ঝিলের জলে কে ভাসালো নীল শালুকের ভেলা

ঝিলের জলে কে ভাসালো
নীল শালুকের ভেলা
মেঘ্‌লা সকাল বেলা।
বেণু-বনে কে খেলে রে
পাতা-ঝরার খেলা।
মেঘ্‌লা সকাল বেলা।।
কাজল-বরণ পল্লী মেয়ে
বৃষ্টি ধারায় বেড়ায় নেয়ে,’
ব’সে দীঘির ধারে মেঘের পানে
রয় চেয়ে একেলা।
মেঘ্‌লা সকাল বেলা।।
দুলিয়ে কেয়া ফুলের বেণী
শাপ্‌লা মালা প’রে
খেল্‌তে এলো মেঘ পরীরা
ঘুম্‌তী নদীর চরে।
বিজলীতে কে দূরে বিমানে
সোনার চুড়ির ঝিলিক্‌ হানে,
বনে বনে কি বসালী
যুঁই-চামেলীর মেলা,
মেঘ্‌লা সকাল বেলা।।

তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী

তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী
কৃষ্ণ মুরারী আগত ঐ
টুটিয়া আগল নিখিল পাগল
সর্বসহা আজি সর্বজয়ী।।
বহিছে উজান অশ্রু-যমুনায়
হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে, ‘আয়’,
বসুধা যশোদার স্নেহধার উথলায়
কাল্‌-রাখাল নাচে থৈ-তা-থৈ।।
বিশ্ব ভরি’ ওঠে স্তব নমো নমঃ
অরির পুরী-মাঝে এলো অরিন্দম।
ঘিরিয়া দ্বার বৃথা জাগে প্রহরী জন
বন্ধ কারায় এলো বন্ধ-বিমোচন,
ধরি’ অজানা পথ আসিল অনাগত
জাগিয়া ব্যথাহত ডাকে, মাভৈঃ।।

অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা, চির-চেনা

অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা, চির-চেনা
ফোটাও মনের বনে তুমি বকুল হেনা। চির-চেনা।।
যৌবন-মদ গর্বিতা তন্বী
আননে জ্যোৎস্না, নয়নে বহ্নি,
তব চরণের পরশ বিনা
অশোক তরু মুঞ্জরে না, চির-চেনা।।
নন্দন-নন্দিনী তুমি দয়িতা চির-আনন্দিতা,
প্রথম কবির প্রথম লেখা তুমি কবিতা।
নৃত্য শেষের তব নূপুরগুলি হায়
রয়েছে ছড়ানো আকাশের তারকায়
সুর-লোক-ঊর্বশী হে বসন্ত-সেনা! চির-চেনা।।

অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে

অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে
প্রদীপ-শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমায়, হে সুন্দর, বন্দিতে!
সঙ্গীতে সঙ্গীতে।।
তোমার দেবালয়ে কি সুখে কি জানি
দু’লে দু’লে ওঠে আমার দেহখানি
আরতি-নৃত্যের ভঙ্গীতে।
সঙ্গীতে সঙ্গীতে।।
পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল
গন্ধে রূপে রসে টলিছে টলমল।
তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত
লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো
তোমার পদতলে রঞ্জিতে।
সঙ্গীতে সঙ্গীতে।।

ভীরু এ মনের কলি ফোটালে না কেন ফোটালে না

ভীরু এ মনের কলি
ফোটালে না কেন ফোটালে না-
জয় করে কেন নিলে না আমারে,
কেন তুমি গেলে চলি।।
ভাঙ্গিয়া দিলে না কেন মোর ভয়,
কেন ফিরে গেলে শুনি অনুনয়;
কেন সে বেদনা বুঝিতে পার না
মুখে যাহা নাহি বলি।।
কেন চাহিলে না জল
নদী তীরে এসে,
সকরুণ অভিমানে চলে গেলে
মরু-তৃষ্ণার দেশে।।
ঝড়ো হাওয়া ঝরা পাতারে যেমন
তুলে নেয় তার বক্ষে আপন
কেন কাড়িয়া নিলে না তেমনি করিয়া
মোর ফুল অঞ্জলি।।

বেল ফুল এনে দাও চাই না বকুল

বেল ফুল এনে দাও চাই না বকুল
চাই না হেনা, আনো আমের মুকুল।।
গোলাপ বড় গরবী
এনে দাও কবরী
চাইতে যুথী আনো টগর-কি ভুল।।
কি হবে কেয়া, দেয়া নাই গগনে;
আনো সন্ধ্যামালতী গোধুলী-লগনে।
গিরি-মল্লিকা কই’
চামেলী পেয়েছে সই
চাঁপা এনে দাও, নয় বাঁধব না চুল।।

কে বিদেশী বন উদাসী

কে বিদেশী বন উদাসী
বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে।
সুর-সোহাগে তন্দ্রা লাগে
কুসুম-বাগের গুল-বদনে।।
ঝিমিয়ে আসে ভোমরা-পাখা
যুঁথীর চোখে আবেশ মাখা
কাতর ঘুমে চাঁদিমা রাকা
ভোর গগনের দর্‌-দালানে
দর্‌-দালানে ভোর গগনে।।
লজ্জাবতীর লুলিত লতায়
শিহর লাগে পুলক-ব্যথায়
মালিকা সম বঁধুরে জড়ায়
বালিকা বঁধু সুখ-স্বপনে।।
বৃথাই গাঁথি, কথার মালা
লুকাস্‌ কবি বুকের জ্বালা,
কাঁদে নিরালা বন্‌শীওয়ালা
তোরই উতালা বিরহী মনে।।

অকূল তুফানে নাইয়া কর পার

অকূল তুফানে নাইয়া কর পার
পাপ দরিয়াতে ডুবে মরি কান্ডারী
নাই কড়ি নাই তরী প্রভু পারে তরিবার।।
থির নহে চিত পাপ-ভীত সদা টলমল
পুণ্যহীন শূণ্য মরু সম হৃদি-তল
নাহি ফুল নাহি ফল,
পার কর হে পার কর ডাকি কাঁদি অবিরল
পার কর হে পার কর
নাহি সঙ্গী নাহি বন্ধু নাহি পথেরই সম্বল।
সাহারায় নাহি জল
শাওন বরিষা সম তব করুণার ধারা
ঝরিয়া পড়ুক পরানে আমার।।

যায় ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে

যায় ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে
দেহের কূলে কে চঞ্চলা দিগঞ্চলা
মেঘ-ঘন-কুন্তলা।
দেয় দোলা পূব-সমীরণে
বনে বনে দেয় দোলা।।
চলে নাগরী দোলে ঘাগরী
কাঁখে বরষা-জলের গাগরী
বাজে নূপুর-সুর-লহরী
রিমি ঝিম্‌, রিম্‌ ঝিম্‌, রিম্‌ ঝিম্‌ চল-চপলা।।
দেয়ারী তালে কেয়া কদম নাচে
ময়ূর-ময়ূরী নাচে তমাল-গাছে।
এলায়ে মেঘ-বেণী কাল-ফণী
আসিল কি দেব-কুমারী
নন্দন-পথ-ভোলা।।

ওরে নীল যমুনার জল!

ওরে নীল যমুনার জল!
বল রে মোরে বল কোথায় ঘনশ্যাম-
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।
আমি বহু আশায় বুক বেঁধে যে এলাম-
এলাম ব্রজধাম।।
তোর কোন্‌ কূলে কোন্‌ বনের মাঝে
আমার কানুর বেণু বাজে,
আমি কোথায় গেলে শুনতে পাব
‘রাধা রাধা’ নাম।।
আমি শুধাই ব্রজের ঘরে ঘরে-
কৃষ্ণ কোথায় বল্‌;
কেন কেউ কহে না কথা,
হেরি সবার চোখে জল।
বল্‌ রে আমার শ্যামল কোথায়,
কোন্‌ মথুরায় কোন দ্বারকায়-
বল্‌ যমুনা বল।
বাজে বৃন্দাবনের কোন্‌ পথে তাঁর
নূপুর অভিরাম।।

স্নিগ্ধ শ্যামবেণী-বর্ণা এস মালবিকা!

স্নিগ্ধ শ্যামবেণী-বর্ণা এস মালবিকা!
অর্জুন-মঞ্জুরী কর্ণে, গলে নীপ-মালিকা, / মালবিকা।।
ক্ষীণা তন্বী জল-ভার-নমিতা
শ্যাম জম্বু-বনে এস অমিতা!
আনো, কুন্দ মালতী-যুঁই ভরি’ থালিকা,- মালবিকা।।
ঘন নীল বাসে অঙ্গ ঘিরে
এস অঞ্জনা বেবা-নদী তীরে!
পরি’ হংস-মিথুন-আঁকা শাড়ি ঝিল্‌মিল্‌
এস ডাগর চোখে মাখি’ সাগরের নীল।
ডাকে বিদ্যুৎ-ইঙ্গিতে দিগ্‌-বালিকা– মালবিকা।।

মহাকালের কোলে এসে গৌরী হ’ল মহাকালী

মহাকালের কোলে এসে
গৌরী হ’ল মহাকালী,
শ্মশান-চিতার ভস্ম মেখে
ম্লান হ’ল মার রূপের ডালি।।
তবু মায়ের রূপ কি হারায়
সে যে ছড়িয়ে আছে চন্দ্র তারায়,
মায়ের রূপের আরতি হয়
নিত্য সূর্য্য-প্রদীপ জ্বালি’।।
উমা হ’ল ভৈরবী হায়
বরণ ক’রে ভৈরবেরে,
হেরি’ শিবের শিরে জাহ্নবীর
শ্মশানে মশানে ফেরে।
অন্ন দিয়ে ত্রি-জগতে
অন্নদা মোর বেড়ায় পথে,
ভিক্ষু শিবের অনুরাগে
ভিক্ষা মাগে রাজদুলালী।।

সন্ধ্যামালতী যবে ফুলবনে ঝুরে

সন্ধ্যামালতী যবে ফুলবনে ঝুরে
কে আসি’ বাজালে বাঁশী ভৈরবী সুরে।
সাঁঝের পূর্ণ চাঁদে অরুণ ভাবিয়া,
পাপিয়া প্রভাতী সুরে উঠিল গাহিয়া
ভোরের কমল ভেবে সাঁঝের শাপলা ফুলে
গুঞ্জরে ভ্রমর ঘুরে ঘুরে।।
বিকালের বিষাদে ঢাকা ছিল বনভুমি,
সকালের মল্লিকা ফুটাইলে তুমি,
রাঙিল উষার রঙে গোধুলি লগন,
শোনালে আশার বাণী বিরহ-বিধুরে।।

মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়

মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়
বিহবল চঞ্চল পায়।।
খর্জুর-বীথির ধারে
সাহারা মরুর পারে
বাজায় ঘুমুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝঙ্কারে।
উড়িয়ে ওড়না ‘লু’ হাওয়ায়
পরী-নটিনী নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর।।
সুর্মা-পরা আঁখি হানে আস্‌মানে,
জ্যোৎস্না আসে নীল আকাশে তার টানে।
ঢেউ তুলে নীল দরিয়ায়
দিল-দরদী নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর।।

রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌ ঝিম্‌ ঘন দেয়া বরষে

রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌ ঝিম্‌ ঘন দেয়া বরষে
কাজরী নাচিয়া চল পুরনারী হরষে।।
কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে,
কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে,
মনের বনের মুকুল খোলে,
নটশ্যাম সুন্দর-মেঘ পরশে।।
হৃদয়-যমুনা আজ কূল জানে না গো,
মনের রাধা আজ বাধা মানে না গো।
ডাকিছে ঘর ছাড়া ঝড়ের (শ্যামের) বাঁশী,
অশনি আঘাত হানে দুয়ারে আসি’।
গরজাক্‌ গুরুজন ভবন-বাসী
আমরা বাহিরে যাব-শ্যাম-মেঘ দরশে।।

যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে

যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে।
ভাঙবে সভা, বসব একা রেবা-নদীর তীরে–
তখন এসো ফিরে।।
গীত শেষে গগন-তলে
শ্রান্ত তনু পড়’বে ঢ’লে
ভালো যখন লাগবে না আর সুরের সারেঙ্গীরে,
তখন এসো ফিরে।।
মোর কন্ঠের জয়ের মালা তোমার গলায় নিও
ক্লান্তি আমার ভুলিয়ে দিও, প্রিয় হে মোর প্রিয়।
ঘুমাই যদি কাছে থেকো
হাতখানি মোর হাতে রেখো
জেগে যখন খুঁজব তোমায় আকুল অশ্রু-নীরে–
তখন এসো ফিরে।।

মোরে ভালোবাসায় ভুলিও না

মোরে ভালোবাসায় ভুলিও না
পাওয়ার আশায় ভুলিও
মোরে আদর দিয়ে তুলিও না
আঘাত দিয়ে তুলিও।।
হে প্রিয় মোর একি মোহ
এ প্রাণ শুধু চায় বিরহ
তুমি কঠিন সুরে বেঁধে আমায়
সুরের লহর দুলিও।।
প্রভু শান্তি চাহে পুরাতে সাধ
আমি চাহি পুড়িতে
সুখের ঘরে আগুন জ্বেলে’
(বঁধু) পথে পথে ঝুরিতে;
নগ্ন দিনের আলোকেতে
চাহি না তোমায় ব’ক্ষে পেতে
তুমি ঘুমের মাঝে স্বপনেতে
হৃদয়-দুয়ার খুলিও।।

মেঘ-বিহীন খর বৈশাখে

মেঘ-বিহীন খর বৈশাখে
তৃষায় কাতর চাতকী ডাকে।।
সমাধি-মগ্না উমা তপতী
রৌদ্র যেন তার তেজ জ্যোতিঃ
ছায়া মাগে ভীতা ক্লান্ত কপোতী
কপোত-পাখায় শুষ্ক শাখে।।
শীর্ণা তটিনী বালুচর জড়ায়ে
তীর্থে চলে যেন শ্রান্ত পায়ে।
দগ্ধ ধরণী যুক্তপাণি
চাহে আষাঢ়ের আশীষ-বাণী,
যাপিয়া নির্জ্জলা একাদশীর তিথি
পিপাসিত আকাশ যাচে কাহাকে।।

দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য্য,

দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য্য,
হে উদার নাথ, দাও প্রাণ।
দাও অমৃত মৃত জনে,
দাও ভীত-চিত জনে,
শক্তি অপরিমাণ।
হে সর্বশক্তিমান।।
দাও স্বাস্থ্য, দাও আয়ু,
স্বচ্ছ আলো, মুক্ত বায়ু,
দাও চিত্ত অনিরুদ্ধ,
দাও শুদ্ধ জ্ঞান।
হে সর্বশক্তিমান।।
দাও দেহে দিব্য কান্তি,
দাও গেহে নিত্য শান্তি,
দাও পুণ্য প্রেম ভক্তি, মঙ্গল কল্যাণ।
ভীতি নিষেধের ঊর্ধে স্থির,
রহি যেন চির-উন্নত শির
যাহা চাই যেন জয় করে পাই
গ্রহণ না করি দান।
হে সর্বশক্তিমান।।

ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে

ভোরে ঝিলের জলে
শালুক পদ্ম তোলে
কে ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী।
ফুল দেখে বেভুল সিনান্‌ বিসরি।।
একি নূতন লীলা আঁখিতে দেখি ভুল
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে আকাশ গাঙে অরুণ-গাগরি।।
ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢল ঢল
গ’লে পড়ে শত সে তরঙ্গে,
শারদ আকাশে দলে দলে আসে
মেঘ, বলাকার খেলিতে সঙ্গে।
আলোক-মঞ্জুরী প্রভাত বেলা
বিকশি’ জলে কি গো করিছে খেলা
বুকের আঁচলে ফুল উঠিছে শিহরি।।

হে পার্থসারথী! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ

হে পার্থসারথী! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ
চিত্তের অবসাদ দূর কর কর দূর
ভয়-ভীত জনে কর হে নিঃশঙ্ক।।
ধনুকে টংকার হানো হানো,
গীতার মন্ত্রে জীবন দানো;
ভোলাও ভোলাও মৃত্যু-আতংক।।
মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে-
শোনাও শোনাও-অনন্ত কাল ধরি’
অনন্ত জীবন প্রবাহ বহে।
দুর্দম দুরন্ত যৌবন-চঞ্চল
ছাড়িয়া আসুক মা’র স্নেহ-অঞ্চল;
বীর সন্তানদল করুক সুশোভিত মাতৃ-অঙ্ক।।

বসন্ত মুখর আজি

বসন্ত মুখর আজি
দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে
বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি’।।
অকারণ ভাষা তা’র ঝর ঝর ঝরে
মুহু মুহু কুহু কুহু পিয়া পিয়া স্বরে,
পলাশ বকুলে অশোক শিমুলে
সাজানো তাহার কল-কথার সাজি।।
দোয়েল, মধুপ বন-কপোত-কূজনে
ঘুম ভেঙে দেয় ভোরে বাসর শয়নে।
মৌনী আকাশ সেই বাণী-বিলাসে
অস্ত-চাঁদের মুখে মৃদু মৃদু হাসে।
বিরহ শীর্ণা গিরি-ঝরণার তীরে
পাহাড়ী বেণু হাতে ফেরে সুর ভাঁজি।।

পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে

পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে।
বলিও আমার পরদেশী রে।।
সে দেশে যবে বাদল ঝরে
কাঁদে না কি প্রাণ একেলা ঘরে,
বিরহ-ব্যাথা নাহি কি সেথা
বাজে না বাঁশী নদীর তীরে।।
বাদল রাতে ডাকিলে “পিয়া পিয়া পাপিয়া”
বেদনায় ভ’রে ওঠে না কি রে কাহারো হিয়া?
ফোটে যবে ফুল ওঠে যবে চাঁদ
জাগে না সেথা কি প্রাণে কোন সাধ?
দেয় না কেহ গুরু গঞ্জনা
সে দেশে বুঝি কুলবতী রে।।

মনে পড়ে আজ সে কোন্‌ জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা

মনে পড়ে আজ সে কোন্‌ জনমে
বিদায় সন্ধ্যাবেলা-
আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এপারে
তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা।।
সেই সে বিদায় ক্ষণে
শপথ করিলে বন্ধু আমার
রাখিবে আমারে মনে,
ফিরিয়া আসিবে খেলিবে আবার
সেই পুরাতন খেলা।।
আজো আসিলে না হায়,
মোর অশ্রুর লিপি বনের বিহগী
দিকে দিকে লয়ে যায়,
তোমায়ে খুঁজে না পায়।
মোর গানের পাপিয়া ঝুরে
গহন কাননে তব নাম লয়ে
আজো পিয়া পিয়া সুরে;
গান থেমে যায়, হায় ফিরে আসে পাখী
বুকে বিঁধে অবহেলা।।

নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে

নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে,
হে প্রিয়, কোথা তুমি দূর প্রবাসে।।
বিহগী ঘুমায় বিহগ-কোলে,
শুকায়েছে ফুল-মালা শ্রান্ত আঁচলে।
ঢুলিছে রাতের তারা চাঁদের পাশে।।
ফুরায় দিনের কাজ ফুরায় না রাতি,
শিয়রের দীপ হায়, অভিমানে নিভে যায়
নিভিতে চাহে না নয়নের বাতি।
কহিতে নারি কথা তুলিয়া আঁখি
বিষাদ-মাখা মুখ গুন্ঠনে ঢাকি।
দিন যায় দিন গুণে নিশি যায় নিরাশে।।

সোনার হিন্দোলে কিশোর-কিশোরী

সোনার হিন্দোলে কিশোর-কিশোরী
দোলে ঝুলনের উৎসব রঙ্গে
বিন্দু বিন্দু বারি অবিরত পড়ে ঝরি’
বাজে তাল জলদ মৃদঙ্গে।।
জড়াইয়া শ্যামে দোলে ভীরু রাধা
থির বিজুরি ডোরে মেঘ যেন বাঁধা
পল্লব কোলে ফুলদলে দোলে
(যেন) গোপীদল গোপীবল্লভ সঙ্গে।।
উল্লাসে থরথর খরতর বহে বায়
পুলকে ডালে ডালে কদম্ব শিহরায়।
দৃষ্টিতে গোপীদের বৃষ্টির লাবনী
আনন্দ উতরোল গাহে বৃন্দাবনী
নূপুর মধুর বাজে যমুনা তরঙ্গে
ঝুলনের উৎসব রঙ্গে।।

ধুলি-পিঙ্গল জটাজুট মেলে

ধুলি-পিঙ্গল জটাজুট মেলে-
আমার প্রলয়-সুন্দর এলে।।
পথে পথে ঝরা- কুসুম ছড়ায়ে,
রিক্ত শাখায় কিশলয় জড়ায়ে,
গৈরিক উত্তরী গগনে উড়ায়ে-
রুদ্ধ-ভবনের দুয়ার ঠেলে।।
বৈশাখী পূর্নিমা চাঁদের তিলক
তোমারে পরাব,
মোর অঞ্চল দিয়া তব জটা নিঙাড়িয়া
সুরধুনি ঝরাব।
যে মালা নিলেনা আমার ফাগুনে,
জ্বালাব তারে তব রূপের আগুনে,
মরণ দিয়া তব চরণ জড়াব
হে মোর উদাসীন, যেওনা ফেলে।।

শুভ্র সমুজ্জ্বল, হে চির-নির্মল

শুভ্র সমুজ্জ্বল, হে চির-নির্মল
শান্ত অচঞ্চল ধ্রুব-জ্যোতি
অশান্ত এ চিত কর হে সমাহিত
সদা আনন্দিত রাখো মতি।।
দুঃখ-শোক সহি অসীম সাহসে
অটল রহি যেন সম্মানে যশে
তোমার ধ্যানের আনন্দ-রসে
নিমগ্ন রহি হে বিশ্বগতি।।
বহে তব ত্রিলোক ব্যাপিয়া, হে গুণী,
ওঙ্কার-সংগীত-সুর-সুরধুনী,
হে মহামৌনী, যেন সদা শুনি
সে সুরে তোমার নীরব আরতি।।

দক্ষিণ সমীরণ সাথে বাজো বেণুকা

দক্ষিণ সমীরণ সাথে বাজো বেণুকা।      
মধুমাধবী সুরে চৈত্র পূর্নিমা রাতে
বাজো বেণুকা।।          
বাজো শীর্ণা-স্রোত নদী-তীরে,                          
বাজো ঘুম যবে নামে বন ঘিরে,              
যবে, ঝরে এলোমেলো বায়ে ধীরে,                     
বাজো বেণুকা।।
মধুমালতী-বেলা-বনে ঘনাও নেশা;
স্বপন আনো জাগরণে মদিরা মেশা।
মন যবে রহে না ঘরে
বিরহ-লোকে সে বিহরে,
যবে নিরাশার বালুচরে
ওড়ে বালুকা।
বাজো বেণুকা, বাজো বেণুকা।।

কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া

কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া
কুহরিল মহুয়া বনে।
চমকি’ জাগিনু নিশীথ শয়নে।।
শূন্য-ভবনে মৃদুল সমীরে
প্রদীপের শিখা কাঁপে ধীরে ধীরে।
চরণ-চিহ্ন রাখি’ দলিত কুসুমে
চলিয়া গেছ তুমি দূরে বিজনে।।
বাহিরে ঝরে ফুল আমি বুঝি ঘরে
বেণু-বনে সমীরণ হাহাকার করে,
ব’লে যাও কেন গেলে এমন ক’রে
কিছু নাহি ব’লে সহসা গোপনে।।

দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে

দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে!
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ-
ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, কার আছে হিম্মত।
কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত,
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।।
তিমির রাত্রি, মাতৃ-মন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান-
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদেরে পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।।
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ-
কান্ডারী, আজি দেখিব তোমার মাতৃ-মুক্তি-পণ।
হিন্দু না ওরা মুসলিম-ওই জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন,
কান্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।।
গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গরজায় গুরু বাজ-
পশ্চাৎ পথ যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ।
কান্ডারী, তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চল টানি’-নিয়েছ যে মহাভার।।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান-
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান!
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ,
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার।।

ওর নিশীথ সমাধি ভাঙিও না

ওর নিশীথ সমাধি ভাঙিও না।
মরা-ফুলের সাথে ঝরিল যে ধুলিপথে
সে আর জাগিবে না, তারে ডাকিও না।।
তাপসিনী-সম তোমারি ধ্যানে
সে চেয়েছিল তব পথের পানে,
জীবনে যাহার মুছিলে না আঁখি ধার -
আজি তাহার পাশে কাঁদিও না।।
মরণের কোলে সে গভীর শান্তিতে
পড়েছে ঘুমায়ে,
তোমারি তরে গাঁথা শুক্‌নো মালিকা
বক্ষে জড়ায়ে।
যে মরিয়া জুড়ায়েছে -
ঘুমাতে দাও তারে আগিও না।।

শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা আয় রে আয়

শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা আয় রে আয়
গিরি-দরী, বনে-মাঠে, প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যায়।।
ধানের ক্ষেতে, বনের ফাঁকে, দেখে যা মোর কালো মাকে
ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিনী বীণ বাজায়।।
ভীরু মেয়ে পালিয়ে বেড়ায় পল্লীগ্রামে একলাটি
বিজনমাঠে গ্রাম সে বসায় নিয়ে কাদা, খড়, মাটি
কালো মেঘের ঝারি নিয়ে করুণা-বারি ছিটায়।।
কাজলা-দীঘির পদ্মফুলে যায় দেখা তার পদ্ম-মুখ
খেলে বেড়ায় ডাকাত-মেয়ে বনে লয়ে বাঘ-ভালুক
ঝড়ের সাথে নৃত্যে মাতে বেদের সাথে সাপ নাচায়।।
নদীর স্রোতে পাথর নুড়ির কাঁকন চুড়ি বাজে তার
সাঁঝের বারান্দাতে দাঁড়ায় টীপ প’রে সন্ধ্যা-তারার।
ধূসর গাঙে ঘট ভরিতে যায় সে মেয়ে ভোর বেলায়।।
হরিত শস্যে লুটায় আঁচল ঝিল্লীতে নূপুর বাজে
ভাটিয়ালী গায় ভাটির স্রোতে গায় বাউল মাঠের মাঝে।
গঙ্গা তীরে শ্মশান ঘাটে কেঁদে কভু বুক ভাসায়।।

এল বনান্তে পাগল বসন্ত

(পরজ-বসন্ত / ত্রিতাল)

এল বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে, চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।
বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,
পান্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।।
কিশলয়ে-পর্ণে অশান্ত ওড়ে তা’র অঞ্চল প্রাস্ত।
পলাশ-কলিতে তা’র ফুল-ধনু লঘু-ভার,
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত।
এলো মেলো দখিনা মলয় রে প্রলাপ বকিছে বনময় রে।
অকারণ মন মাঝে বিরহের বেণু বাজে।
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত।।

কানন গিরি সিন্ধু পার ফিরনু পথিক দেশ-বিদেশ

কানন গিরি সিন্ধু পার ফিরনু পথিক দেশ-বিদেশ।
ভ্রমিনু কতই রূপে এই সৃজন ভুবন অশেষ।।
তীর্থ পথিক এই পথের ফিরিয়া এল না কেউ,
আজ এ পথে যাত্রা কর, কাল নাহি তার চিহ্ন লেশ।।
রাত্রি-দিবার রঙমহল চিত্রিত চন্দ্রতাপ,
দু’দিনের এ পান্থবাস এই ভুবন-এ সুখ-আবেশ।।
ভোগ-বিলাসী “জমশেদের” জলসা ছিল এই যে দেশ,
আজ শ্মশান, ছিল যেথায় “বাহরামের” আবাশ আয়েশ।।

আমি পথ-মঞ্জুরী ফুটেছি আঁধার রাতে

(পঠমঞ্জরী-ঢিমা ত্রিতাল)
আমি পথ-মঞ্জুরী ফুটেছি আঁধার রাতে,
গোপন অশ্রু-সম রাতের নয়ন-পাতে।
দেবতা চাহেনা মোরে,
গাঁথে না মালার ডোরে,
অভিমানে তাই ভোরে শুকাই শিশির-সাথে।।
মধুর সুরভি ছিল আমার পরাণ ভরা,
আমার কামনা ছিল মালা হয়ে ঝরে পড়া।
ভালবাসা পেয়ে যদি
কাঁদিতাম নিরবধি,
সে বেদনা ছিল ভাল সুখ ছিল সে কাঁদাতে।

আজি মনে মনে লাগে হরি

আজি মনে মনে লাগে হরি
আজি বনে বনে জাগে হরি।।
ঝাঁঝর করতাল খরতালে বাজে
বাজে কংকন চুড়ি মৃদুল আওয়াজে
লচকিয়া আসে মুচকিয়া হাসে
প্রেম-উল্লাসে শ্যামল গৌরী।।
কদম্ব তমাল রঙ্গে লালে লাল
লাল হলো কৃষ্ণ ভ্রমর ভ্রমরী
রঙ্গের উজান চলে কালো যমুনার জলে
আবীর রাঙ্গা হলো ময়ূর-ময়ূরী।।
মোর হৃদি বৃন্দাবন যেন রাঙে
রাধা শ্যাম যুগল চরণ রাগে
ও চরণ ধূলি যেন ফাগ হ’য়ে মেশে রে
অন্তরে পড়ে মোর ঝরি’।।

আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া

(হাস্বৗর-ত্রিতাল)
আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া।
চম্পা কুঞ্জে আজি গুঞ্জে ভ্রমরা-কুহরিছে পাপিয়া।।
প্রেম-কুসুম শুকাইয়া গেল হায়!
প্রাণ-প্রদীপ মোর হের গো নিভিয়া যায়,
বিরহী এসে ফিরিয়া।।
তোমারি পথ চাহি হে প্রিয় নিশিদিন
মালার ফুল মোর ধুলায় হ’ল মলিন
জনম গেল ঝুরিয়া।।

বউ কথা কও, বউ কথা কও

বউ কথা কও, বউ কথা কও
কও কথা অভিমানী।
সেধে সেধে কেঁদে কেঁদে
যাবে কত যামিনী।।
সে কাঁদন শুনি হের নামিল নভে বাদল
এলো পাতার বাতায়নে যুঁই চামেলী কামিনী।।
আমার প্রাণের ভাষা শিখে
ডাকে পাখি ‘পিউ কাঁহা,’
খোঁজে তোমায় মেঘে মেঘে
আঁখি মোর সৌদামিনী।।

অরুণকান্তি কেগো যোগী ভিখারী

আহীর ভৈরব / ত্রিতাল

অরুণকান্তি কেগো যোগী ভিখারী।
নীরবে হেসে দাঁড়াইলে এসে
প্রখর তেজ তব নেহারিতে নারি।।
রাস-বিলাসিনী আমি আহিরিণী
শ্যামল-কিশোর-রূপ শুধু চিনি
অম্বরে হেরি আজ একি জ্যোতি-পুঞ্জ?
হে গিরিজাপতি! কোথা গিরিধারী।।
সম্বর সম্বর মহিমা তব
হে ব্রজেশ ভৈরব! আমি ব্রজবালা,
হে শিব সুন্দর! বাঘছাল পরিহর-
ধর নটবর বেশ পর নীপমালা।
নব-মেঘ-চন্দনে ঢাকি’ অঙ্গগজ্যোতি
প্রিয় হ’য়ে দেখা দাও ত্রিভুবন-পতি,
পার্ব্বতী নহি আমি, আমি শ্রীমতী,
বিষাণ ফেলিয়া হও বাঁশরী-ধারী।।

মোদের এই শিকল পরা ছল

মোদের এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই
শিকল তোদের করব রে বিকল।।
তোদের বন্ধ কারায় আসা
মোদের বন্দী হতে নয়
ওরে ক্ষয় করতে আসা
মোদের সবার বাঁধন ভয়
এই বাঁধন পরেই বাঁধন ভয়কে
করব মোরা জয়
এই শিকল বাঁধা পা নয়
এ শিকল ভাঙ্গা কল।।
ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন
এই শিকল ঝনঝনা
এ যে মুক্তিপথের অগ্রদূতের
চরণ বন্দনা।
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে
হানছে লাঞ্ছনা
ওদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে
আবার বজ্রানল।।

ভরিয়া প্রাণ শুনিতেছি গান

ভরিয়া প্রাণ শুনিতেছি গান
আসিবে আজ বন্ধু মোর।
স্বপন মাখিয়া সোনার পাখায়
আকাশে উধাও চিত-চকোর।
আসিবে আজই বন্ধু মোর।।
হিজল বিছানো বন পথ দিয়া
রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।
নদীর পারে বন কিনারে
ইঙ্গিত হানে শ্যাম কিশোর।
আসিবে আজই বন্ধু মোর।।
চন্দ্রচূড় মেঘের গায়
মরাল-মিথুন উড়িয়া যায়,
নেশা ধরে চোখে আলো-ছায়ায়
বহিছে পবন গন্ধ চোর।
আসিবে আজই বন্ধু মোর।।

ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি

ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি
ভোরের হাওয়ায় কান্না পাওয়ায় তব ম্লান ছবি
নীরব কেন কবি।।
যে বীণা তোমার পায়ের কাছে
বুক ভরা সুর লয়ে জাগিয়া আছে
তোমার পরশে ছড়াক হরষে
আকাশে বাতাসে তার সুরের সুরভি
নীরব কেন কবি।।
তোমার যে প্রিয়া
গেল বিদায় নিয়া
অভিমানে রাতে
গোলাপ হয়ে ফুটুক তাহারই কামনা
উদাস প্রাতে
ফিরে যে আসবে না ভুলো তাহারে
চাহ তাহার পানে দাঁড়ায় যে দ্বারে
অস্ত চাঁদের বাসনা ভুলাতে
অরুণ অনুরাগে উদলি রবি
নীরব কেন কবি।।

নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল

নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল
ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল।।
ফুল যদি নিই তোমার হাতে
জল রবে গো নয়ন পাতে
অশ্রু নিলে ফুটবে না আর প্রেমের মুকুল।।
মালা যখন গাঁথ তখন পাওয়ার সাধ যে জাগে
মোর বিরহে কাঁদ যখন আরও ভালো লাগে।
পেয়ে তোমায় যদি হারাই
দূরে দূরে থাকি গো তাই
ফুল ফোটায়ে যায় গো চলে চঞ্চল বুলবুল।।

যাবার বেলা ফেলে যেয়ো একটি খোঁপার ফুল

যাবার বেলা ফেলে যেয়ো একটি খোঁপার ফুল।
আমার চোখে চেয়ে চেয়ো একটু চোখের ভুল।।
অধর কোণের ঈয়ৎ হাসির ক্ষণিক আলোকে
রাঙ্গিয়ে যেয়ো আমার নব গ্রহণ কালোকে,
যেতে যেতে মুখ ফিরিয়া দুলিয়ে যেও দুল।।
একটি কথা’ ক’য়ে যেয়ো একটি নমস্কার,
সেই কথাটি গানের সুরে গাইব বারে বার,
হাত ধরে মোর বন্ধু ভুলো একটু মনের ভুল।।

গানগুলি মোর আহত পাখির সম

গানগুলি মোর আহত পাখির সম
লুটাইয়া পড়ে তব পায় প্রিয়তম।।
বাণ বেধা মোর গানের পাখিরে
তু’লে নিও প্রিয় তব বুকে ধীরে,
লভিবে মরণ চরণে তোমার
সুন্দর অনুপম।।
তারা সুখের পাখায় উড়িতেছিল গো নভে,
তব নয়ন শায়কে বিঁধিলে তাহাদের কবে।
মৃত্যু আহত কন্ঠে তাহার
একি এ গানের জাগিল জোয়ান,
মরণ বিষাদে অমৃতের স্বাদ
আনিলে বিষাদ মম।।

বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজই দোল

বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজই দোল।
আজো তা’র ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি, তন্দ্রাতে বিলোল।
আজো হায় রিক্ত শাখায় উত্তরী বায় ঝুরছে নিশিদিন,
আসেনি, যখন’ হাওয়া গজল গাওয়া, মৌমাছি বিভোল।।
কবে সে ফুল কুমারী ঘোমটা চিরি’ আসবে বাহিরে,
গিশিরের স্পর্শমুখে ভাঙ্গবে, রে ঘুম রাঙবে, রে কপোল।।
ফাগুনের মুকুল জাগা দুকুল ভাঙ্গা আসবে ফুলের বান,
কুঁড়িদের ওষ্ঠপুটে লুটবে হাসি, ফুটবে গালে টোল।।
কবি তুই গন্ধে ভু’লে ডুবলি জলে কূল পেলিনে আর,
ফুলে তোর বুক ভরেছিল, আজকে জলে ভরবে আঁখির কোল।।

খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে

খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে
ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।।
দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ বদলাতে
চাই না বেহেশত খোদার কাছে নিত্য মোনাজার ক’রে।।
কায়েস যেমন লায়লী লাগি’ লভিল মজনু খেতাব,
যেমন ফরহাদ শিরীর প্রেমে হ’ল দিওয়ানা বেতাব,
বে-খুদীতে মশগুল আমি তেম্‌ খোদার তরে।।
পুড়ে মরার ভয় না রাখে, পতঙ্গ আগুনে ধায়,
সিন্ধুতে মেটে না তৃষ্ণা চাতক বারি বিন্দু চায়,
চকোর চাহে চাঁদের সুধা, চাঁদ সে আসমানে কোথায়
সুরুয থাকে কোন্‌ সুদূরে সূর্যমুখী তারেই চায়,
তেমনি আমি চাহি খোদায়, চাহিনা হিসাব ক’রে।।

শূণ্য এ বুকে পাখি মোর আয়

শূণ্য এ বুকে পাখি মোর আয়
ফিরে আয় ফিরে আয়।
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়।।
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ
পান্ডুর হলো আকাশের চাঁদ
কেঁদে নদী হলো করুণ বিষাদ
ডাকে আয় তীরে আয়।।
আকাশে মেলিয়া শত শতকর
খোঁজে তোরে তবু ওরে সুন্দর
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড়
লুটায় লতা ধূলায়।।
তুই ফিরে এলে ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বন ফুল দল
ধূসর আকাশ হইবে সুনীল
তোর চোখের চাওয়ায়।।

আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়

আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়
আমার কথার ফুল গো আমার গানের মালা গো
কুড়িয়ে তুমি নিও

আমার সুরের ইন্দ্রধনু
রচে আমার ক্ষনিক তনু
জড়িয়ে আছে সেই রংয়ে মোর অনুরাগ অমিয়
মোর আখি পাতায় নাই দেখিলে আমার আঁখিজল
মোর কন্ঠের সুর অশ্রুভারে করে টলমল
আমার হৃদয় -পদ্ম ঘিরে
কথার ভ্রমর কেদে ফিরে
সেই ভ্রমরের কাছে আমার মনের মধু পিও

আমায় নহে গো ভালোবাসো

আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু
ভালোবাসো মোর গান
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে
গান হলে অবসান ।

চাঁদেরে কে চায় জোসনা সবাই যাচে
গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলি মাঝে
তুমি বুঝিবে না
আলো দিতে কত পোড়ে
কত প্রদীপের প্রাণ ।
যে কাটা লতার আখিঁজল
ফুল হয়ে উঠে ফুটে
ফুল নিয়ে তার দিয়েছো কি কিছু
শূন্য পত্র পুটে ।
সবাই তৃষ্ণা মেটায় নদীর জলে
কি তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া তলে
বেদনার মহা সাগরের কাছে করো সন্ধান ।

কেন আনো ফুলোডোর

কেন আনো ফুলোডোর
আজি বিদায়ও বেলা
মোছো মোছো আঁখিলোর
যোগী ভাঙ্গিলো মেলা

কেন মেঘেরো স্বপন
আনো মরূরও চোখে
ভুলে দিও না কুসুম
যারে দিয়েছো হেলা
যবে শুকালো কানন
এলে বিঁধুর পাখি
লয়ে কাঁটা ভরা প্রান
একি নিঠুরও খেলা
যদি আকাশ কুসুম
পেলি চকিতে কবি
চলো চলো মুসাফির
ডাকে পারেরও বেলা
আছে বাহুরও বাঁধন
তব শয়ন সাথি
আমি এসেছি একা
আমি চলি একেলা

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম
মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,
মোরা বিধাতার মত নির্ভয়
মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।
মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,
বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন
চিত্তমুক্ত শতদল।।
মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল
মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর।
কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল
মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর,
মোরা শক্তি অটল মহীধর।
হাসি গান শ্যাম উচ্ছল
বৃষ্টির জল বনফল খাই-
শয্যা শ্যামল বনতল।।

পদ্মার ঢেউ রে

পদ্মার ঢেউ রে–
মোর শূণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙ্গা পা
আমি হারায়েছি তা’রে ॥

মোর পরান বঁধু নাই,
পদ্মে তাই মধু নাই–নাই রে–
বাতাস কাঁদে বাইরে–
সে সুগন্ধ নাই রে–
মোর রূপের সরসীতে আনন্দ-মৌমাছি
নাহি ঝঙ্কারে ॥
ও পদ্মা রে ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো
মোর বঁধুয়ার রূপ তেমনি ঝিল্‌মিল ঝিল্‌মিল করে কৃষ্ণ-কালো
সে প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁশী বাজায়
যদি দেখিস্‌ তারে–দিস্‌ এই পদ্ম তার পায়
বলিস্‌ কেন বুকে আশার দেয়ালী জ্বালিয়ে
ফেলে গেল চির-অন্ধকারে ।।
পদ্মার ঢেউ রে
মোর শূণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে ॥
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙ্গা পা
আমি হারায়েছি তারে ॥

চোখ গেল চোখ গেল

চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে
চোখ গেল পাখি রে
তোর চোখে কাহারো চোখ পড়েছে নাকি রে
চোখ গেল পাখি রে ।

তোর চোখের বালির জ্বালা জানে সবাই রে
জানে সবাই
চোখে যার চোখ পড়ে তার ওষুধ নাইরে
তার ওষুধ নাই
কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয় কাহার আঁখিরে
চোখ গেল পাখি রে ।
তার চোখের জ্বালা বুঝি
নিশি রাতে বুকে লাগে
চোখ গেল ভুলে রে পিউ কাহা পিউ কাহা
বলে তাই ডাকিস অনুরাগে রে
ওরে ,
বনপাপিয়া কাহার গোপন পিয়া ছিলি আর জনমে
আজো ভুলতে নারি আজো ঝুরে হিয়া
ওরে পাপিয়া বল যে হারায় তাহারে কি
পাওয়া যায় ডাকিরে ।

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই
কেন মনে রাখো তারে
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।।
আমি গান গাহি আপনার সুখে
তুমি কেন এসে দাঁড়াও সম্মুখে
আলেয়ার মতো ডাকিও না আর
নিশীথ অন্ধকারে।।
দয়া করো
দয়া করো আর আমারে লইয়া
খেলো না নিঠুর খেলা
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না সেই
শুভ লগনের বেলা
প্রিয় শুভ লগনের বেলা
আমি ফিরি পথে তাহে কার ক্ষতি
তব চোখে কেন সজল মিনতী
আমি কি ভুলেও কোন দিনও
এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে।।

মোর ঘুম ঘোরে কে এলে মনোহর

মোর ঘুম ঘোরে কে এলে মনোহর
শ্রাবণ মেঘে নাচে নটবর
নমো নমো নমো নমো
ঝম ঝম ঝম ঝম ।

শিয়রে বসি চুপি চুপ চুমিলে নয়ন
মোর বিকশিল আবেশে তনু
নীপসম নিরূপম মনোরম ।
মোর ফুলবনে ছিল যত ফুল
ভরি ডালি দিনূ ঢালি দেবতা মোর ।
হায় নিলে না সে ফুল ছি ছি বেভুল
নিলে তুলি খোপা খুলি কুসুম ডোর
স্বপনে কি যে কয়েছি তাই গিয়াছে চলে
জাগিয়া কেদে ডাকি দেবতায়
প্রিয়তম প্রিয়তম প্রিয়তম ।।

দূর দ্বীপবাসীনি চিনি তোমারে চিনি

দূর দ্বীপবাসীনি, চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনিরো দেশে, তুমি বিদেশীনিগো
সুমন্দভাসীনি।।

প্রশান্ত সাগরে তুফানেও ঝড়ে
শুনেছি তোমারি অশান্ত রাগীনি।।
বাজাও কি বুণো সুর পাহাড়ী বা‍শীতে
বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী হাসিতে।।
তব কবরী মূলে, নব এলাচীরো ফুল
দুলে কুসুম বিলাসিনী।।

মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম

মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম
ছিলাম নদীর চরে
যুগলরুপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে ।

তমালতরু চাঁপা লতার মতো
জড়িয়ে কত জনম হল গত
সেই বাধনের চিহ্ন আজো জাগে
জাগে হিয়ার থরে থরে ।।
বাহুর ডোরে বেধে আজো ঘুমের ঘোরে যেন
ঝড়ের বন লতার মতো লুটিয়ে কাদ কেন?
বনের কপোত কপোতাক্ষীর তীরে
পাখায় পাখায় বাধা ছিলাম নীড়ে
চিরতরে হলো ছাড়াছাড়ি
নিঠুর ব্যাধের শরে ।।

আলগা কর গো খোঁপার বাধন

আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন
দীল ওহি মেরা ফাস্ গেয়ি
বিনোদ বেনীর জরীণ ফিতায়
আন্ধা ইশক মেরা কস্ গেয়ি ।।

তোমার কেশের গন্ধে কখন
লুকায়ে আসিল লোভী আমার মন
বেহুশ হো কর গির পারি হাতমে
বাজু বান্দমে বস্ গেয়ি ।।
কানের দুলে প্রাণ রাখিলে বিধিয়া
আখঁ ফেরা দিয়া চোরি কার নিদিয়া
দেহের দেউরিতে বেড়াতে আসিয়া
আউর নেহি উয়ো ওয়াপাস গেয়ি ।।

প্রজাপতি প্রজাপতি

প্রজাপতি প্রজাপতি
কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গীন পাখা
টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা।।
তুমি টুলটুলে বন-ফুলে মধু খাও
মোর বন্ধু হয়ে সেই মধু দাও,
ওই পাখা দাও সোনালী-রূপালী পরাগ মাখা।।
মোর মন যেতে চায় না পাঠশালাতে
প্রজাপতি, তুমি নিয়ে যাও সাথী করে তোমার সাথে।
তুমি হাইয়ায় নেচে নেচে যাও
আর তোমার মত মোরে আনন্দ দাও,
এই জামা ভাল লাগে না দাও জামা ছবি-আঁকা।।

খেলিছে জলদেবী

খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে
তরঙ্গ লহর তোলে লীলায়িত কুন্তলে।।
জল ছল ঊর্মী নূপুর শ্রোতনীরে বাজে সুমধুর
জল চঞ্চল ছল কাঁকন কেউর
ঝিনুকের মেখলা কটিতে দোলে।।
আনমনে খেলে চলে বালিকা
খুলে পড়ে মুকুতা মালিকা
হরষিত পারাবারে ঊর্মী জাগে
লাজে চাঁদ লুকালো গগন তলে।।

হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে

হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
কুড়ায়ে ঝরা ফুল একেলা আমি
তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়
সুখের স্বরগ হইতে নামি ।

চারিদিকে মোর উড়িছে কেবল
শুকানো পাতা মলীণ ফুলদ্বয়
বৃথাই সেথা হায় তব আঁখিজল
ছিটাও অবিরল দিবসযামী ।
এলে অবেলায় পথিক বেভুল
বিদিছে কাটা নাহি পাবে ফুল
কি দিয়ে বরণ করি ও চরণ
নিভিছে জীবন জীবনস্বামী ।

বসিয়া বিজনে কেন একা মনে

( মন-মিশ্র গজল কাহারবা)

বসিয়া বিজনে কেন একা মনে
পাণিয়া ভরণে চল লো গোরী
চল জলে চল কাদে বনতল
ডাকে ছল ছল জল লহরী ।।

দিন চলে যায় বলাকা পাখায়
বিহগের বুকে বিহগী লুকায়
কেদে চখা চখা মাগিছে বিদায়
বারোয়ার সুরে ঝুরে বাশরি ।।
সাঝ হেরে মুখ চাদ কুমুরে
ছায়াপথ সিথি রচি চিকুরে
নাচে ছায়া -নটি কানন-পুরে
দুলে রটপট লতা কবরী ।।
‌বেলা গেল বধু ডাকে ননদী
চ’লো জল নিতে যাবি লো যদি
কালো হয়ে আসে সুদূর নদী
নাগরিকা-সাজে সাজে নগরী ।।
মাঝি বাধে তরী সিনান-ঘাটে
ফিরিছে পথিক বিজন মাঠে
কারে ভেবে বেলা কাদিয়া কাটে
ভর আখি-জলে ঘট পাপড়ি ।।
ওগো বেদরদী ও রাঙা পায়ে
মালা হয়ে কে গো গেল জড়ায়ে
তব সাথে কবি পড়িল গায়ে
পায়ে রাখি তার না গলে পড়ি ।।

মুছাফির মোছ রে আঁখিজল

মুছাফির মোছ রে আঁখিজল
ফিরে চল আপনারে নিয়া
আপনি ফুটেছিল ফুল
গিয়াছে আপনি ঝরিয়া ।।

রে পাগল একি দুরাশা
জলে তুই বাঁধবি বাসা
মেটে না হেথায় পিয়াসা
হেথা নাই তৃষা দরিয়া।।
বরষায় ফুটল না বকুল
পউষে ফুটিবে কি সে ফুল
এদেশে ঝরে শুধু ফুল
নিরাশার কানন ধরিয়া ।।
রে কবি কতই দেয়ালি
জ্বালিলি তোর আলো জ্বালি
এলো না তোর বনমালী
আধার আজ তোরই দুনিয়া ।।

নূরজাহান! নূরজাহান!

নূরজাহান! নূরজাহান!
সিন্ধু নদীতে ভেসে,
এলে মেঘলামতীর দেশে
ইরানী গুলিস্তান।।
নার্গিস লালা গোলাপ আঙ্গুর-লতা
শিরিঁ ফরহাঁদ সিরাজের উপকথা
এনেছিলে তুমি তনুর পেয়ালা ভরি’
বুলবুলি দিলরুবা রবাবের গান।।
তব প্রেমে উন্মাদ ভুলিল সেলিম,
সে যে রাজাধিরাজ-
চন্দন সম মাখিল অঙ্গে
কলঙ্ক লোক-লাজ।
যে কলঙ্ক লয়ে হাসে চাঁদ
নীল আকাশে,
যাহা লেখা থাকে শুধু
প্রেমিকের ইতিহাসে,
দিবে চিরদিন নন্দন-লোক-চারী
তব সেই কলঙ্ক
সে প্রেমের সম্মান।।

এই রাঙামাটির পথে লো

এই রাঙামাটির পথে লো
মাদল বাজে বাজে বাঁশের বাঁশি।
বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো
মন লাগে না কাজে লো
রইতে নারি ঘরে ওলো
প্রাণ হলো উদাসী লো ।।

মাদলীয়ার তালে তালে
অঙ্গ ওঠে দুলে লো ।
দোল লাগে শাল পিয়াল বনে
নতুন খোপার ফুলে লো
মহুয়া বনে লুটিয়ে পরে
মাতাল চাঁদের হাসি লো ।।
চোখে ভালো লাগে যাকে
তারে দেখবো পথের বাঁকে ।
তার চাচড় কেশে পড়িয়ে দেবো
ঝুমকো জবার ফুল
তার গলার মালার কুসুম কেড়ে
পড়বো কানের দুল ।
তার নাচের তালের ইশারাতে
বলবো ভালোবাসি লো ।।

Friday 11 November 2011

আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া

আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া
চম্পা কুঞ্জে আজি গুঞ্জে ভ্রমরা-কুহরিছে পাপিয়া।
প্রেম-কুসুম শুকাইয়া গেল হায়!
প্রাণ-প্রদীপ মোর হের গো নিভিয়া যায়,
বিরহী এসে ফিরিয়া।
তোমারি পথ চাহি হে প্রিয় নিশিদিন
মালার ফুল মোর ধুলায় হ’ল মলিন
জনম গেল ঝুরিয়া।।

Thursday 10 November 2011

রুমঝুম রুমুঝুম কে বাজায়

রুমঝুম রুমুঝুম কে বাজায়,
জল ঝুম্‌ঝুমি
চমকিয়া জাগে ঘুমন্ত বনভূমি।

দুরন্ত অরণ্যা গিরি-নির্ঝরিণী
রঙ্গে সঙ্গে লয়ে বনের হরিণী
শাখায় শাখায় ঘুম ভাঙ্গায়
ভীরু মুকুলের কপোল চুমি।

কুহু-কুহু কুহরে পাহাড়ী কুহু,
পিয়াল ডালে
পল্লব-বীণা বাজায় ঝিরিঝিরি সমীরণ,
তারি তালে তালে।

সেই জল-ছলছল সুরে জাগিয়া
সাড়া দেয় বন-পারে বাঁশী রাখালিয়া
পল্লীর প্রান্তর ওঠে শিহরি
বলে - ‘চঞ্চলা কে গো তুমি’?

Saturday 5 November 2011

কাব্য-গীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্ঠা, দ্রষ্ঠা, ঋষি ও ধ্যানী

কাব্য-গীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্ঠা, দ্রষ্ঠা, ঋষি ও ধ্যানী
মহাকবি রবি অস্ত গিয়াছে!
বীণা, বেণুকা ও বাণী নীরব হইল।
ধুলির ধরণী জানিনা সে কত দিন
রস- যমুনার পরশ পাবেনা।
প্রকৃতি বাণীহীন মৌন বিষাদে কাঁদিবে ভুবনে ভবনে ও বনে একা;
রেখায় রেখায় রুপ দিবে আর কাহার ছন্দ লেখা?
অপ্রাকৃত মদনে মাধবী চাঁদের জ্যোৎস্না দিয়া
রূপায়িত রসায়িত করিবে কে লেখনী, তুলিকা নিয়া?

ব্যাস, বাল্মীকি,কালিদাস, খৈয়াম, হাফিজ ও রুমী
আরবের ইমরুল কায়েস যে ছিলে এক সাথে তুমি!
সকল দেশের সক্ল কালের সকল কবিরে ভাঙ্গি'
তাঁহাদের রুপে রসে রাঙ্গাইয়া, বুঝি কত যুগ জাগি'
তোমারে রচিল রসিক বিধাতা, অপরুপ সে বিলাস,
তব রুপে গুনে ছিল যে পরম সুন্দরের আভাস।

Friday 14 October 2011

আমার গানের মালা আমি করবো কারে দান

আমার গানের মালা
আমি করব কারে দান
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান
মালা করব কারে দান
চোখে মলিন কাজল রেখা
কন্ঠে কাঁদে কুহু কেকা
কপোলে যার অশ্রু রেখা
একা যাহার প্রান
শাঁখায় ছিল কাঁটার বেদন
মালায় শুচির জ্বালা
কন্ঠে দিতে সাহস না পাই
অভিশাপের মালা
বিরহে যার প্রেম- আরতি
আঁধার লোকের অরুন্ধতি
নাম না জানা সেই তপোতী
তার তরে এই গান
মালা করব তারে দান

যেদিন লব বিদায়

যেদিন লব বিদায় ধরা ছাড়ি পিয়ে
ধুয়ো লাশ আমার লাল পানি দিয়ে।
শরাবী জামসেদি গজল জানাজায় গাহিও আমার
দিবে গোর খুঁড়িয়া মাটি, খয়রাবি ওই শরাবখানায়।
রোজ কেয়ামতে তাজা উঠব জিয়ে।
এমনি পাব শরাব, ভেসে যাব তাহারি স্রোতে
উঠিবে খুশবু শরাবের আমার ওই গোরের পার হতে।
টলি পড়বে পথিক সে নেশায় ঝিমিয়ে।।

আমি চিরতরে দূরে চলে যাব

আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,
তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।
আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশে
বেণী যাবে যবে খুলিতে
তোমার সুরের নেশায় যখন
ঝিমাবে আকাশ কাঁদিবে পবন,
রোদন হইয়া আসিব তখন তোমার বক্ষে দুলিতে।।
আসিবে তোমার পরমোৎসবে কত প্রিয়জন কে জানে,
মনে প’ড়ে যাবে–কোন্‌ সে ভিখারী পায়নি ভিক্ষা এখানে।
তোমার কুঞ্জ-পথে যেতে, হায়!
চমকি’ থামিয়া যাবে বেদনায়
দেখিবে, কে যেন ম’রে মিশে আছে তোমার পথের ধূলিতে।


তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়

তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
সেকি মোর অপরাধ?
চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিনী
বলে না তো কিছু চাঁদ
চেয়ে চেয়ে দেখি ফুটে যবে ফুল
ফুল বলে না তো সে আমার ভুল
মেঘ হেরী ঝুরে চাতকিনী
মেঘ করে না তো প্রতিবাদ
জানে সূর্যরে পাবেনা
 তবু অবুঝ সূর্যমুখী
চেয়ে চেয়ে দেখে তার দেবতারে
দেখিয়াই সে যে সুখি
হেরিতে তোমার রূপ-মনোহর
পেয়েছি এ আঁখি, ওগো সুন্দর
মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর নয়নের
সেই সাধ


শাওনো রাতে যদি স্বরনে আসে মোরে

শাওনো রাতে যদি স্মরনে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে
ভুলিও স্মৃতি মম নিশীথ স্বপ্ন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে
ঝরিবে পুবালী বায় গহন দুর বনে
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে
বিরহি কুহু কেকা, গাহিবে নীপ-শাখে
যমুনা নদী পারে, শুনিবে কে যেন ডাকে
বিজলী দ্বীপ- শিখা, খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া
দু'হাতে ঢেকো আঁখি, যদি গো জলে ভরে

Tuesday 11 October 2011

আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়

আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়
মোছ আঁখি দুয়ার খোল দাও বিদায়।।
ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে
ঝরে ধুলায় ভোর বেলাতে।।
আমায় তারা ডাকে সাথী
আয়রে আয় 
সজল করুন আঁখি তোলো  দাও বিদায়
অন্ধকারে এসেছিলাম
থাকতে আঁধার যাই চলে
ক্ষনেক ভালবেসেছিলে চিরকালের নাই হলে
হল চেনা হল দেখা
নয়ন জলে রইল লেখা
দর বিরহী ডাকে কেকা বরষায়
ফাগুন স্বপন ভোলো ভোলো দাও বিদায়।।

মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী

মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির,
চৈতী চাঁদের দুল।।
কন্ঠে তোমার পরাবো বালিকা,
হংস-সারির দুলানো মালিকা।
বিজলী জরীণ ফিতায় বাঁধিব,
মেঘ রঙ এলো চুল।।
জ্যোছনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হতে লাল রঙ ছানি
আলতা পরাবো পায়।
আমার গানের সাত সুর দিয়া,
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া।
তোমারে ঘেরিয়া গাহিবে আমার,
কবিতার বুলবুল।।

লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া

লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো।
প্রিয়তম! এতদিনে বিরহের নিশি বুঝি ভোর হলো।।
মজনু! তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু-নদী পর্বতে
বন্দিনী আজ ভেঙেছে পিঞ্জর বাহির হয়েছে পথে।
আজি দখিনা বাতাস বহে অনুকূল,
ফুটেছে গোলাপ নার্গিস ফুল,
ওগো বুলবুল, ফুটন্ত সেই গুলবাগিচায় দোলো।।
বনের হরিণ-হরিণী কাঁদিয়া পথ দেখায়েছে মোরে,
হুরী ও পরীরা ঝুরিয়া ঝুরিয়া চাঁদের প্রদীপ ধ’রে
পথ দেখায়েছে মোরে।
আমার নয়নে নয়ন রাখিয়া
কি বলিতে চাও, হে পরান-পিয়া!
নাম ধ’রে ডাকো ডাকো মোরে স্বামী
ভোলো অভিমান ভোলো।।

Sunday 9 October 2011

খেলিছ এ বিশ্বলয়ে

খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট শিশুর আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা 
নির্জনে প্রভু নির্জনে।।
শূণ্যে মহা আকাশে (তুমি) মগ্ন লীলা বিলাসে
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে
নির্জনে প্রভু নির্জনে।।
তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি।
নিত্য তুমি হে উদার
সুখে-দুখে অবিকার।
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে
নির্জনে প্রভু নির্জনে।।

(এটা টাইপ করার সময় আমার লিলি খালাম্মার কথা মনে উঠল। আমার খাতার মধ্যে উনি এই গানটা লিখে দিয়েছিল। ১৯৯৯ সনে। সেদিন প্রথম শুনলাম, গানটা উনার একটা প্রিয় গান। খাতাটা নেই, কিন্তু গানের পাতাটা রেখে দিয়েছি :) )

Saturday 30 July 2011

শুকনো পাতার নুপূর পায়ে

শুকনো পাতার নুপূর পায়ে
নাচিছে ঘূর্ণি বায়।
জল তরঙ্গে ঝিলমিল-ঝিলমিল
ঢেউ তুলে সে যায়।।

দীঘির বুকে শতদল দলি,
ঝরায়ে বকুল চাঁপার কলি,
চঞ্চল ঝরণার জল ছলছলি,
মাঠের পথে সে ধায়।।

বনফুল-আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া,
আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া
পাগলিনী নেচে যায় হেলিয়া দুলিয়া
ধূলি-ধূসর কায়।।

ইরানী বালিকা যেন মরু-চারিণী
পল্লীর প্রান্তর-বন মনোহারিণী
ছুটে আসে সহসা গৈরি-বরণী
বালুকার উড়নী গায়।।

ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি

ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।
করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি।।
ফুল ফুটিয়ে ভোর বেলা কে গান গেয়ে,
নীরব হ’ল কোন বিষাদের বান খেয়ে,
বনের কোলে বিলাপ করে সন্ধ্যারাণী চুল খুলি।।
কাল হতে আর ফুটবে না হায়, লতার বুকে মঞ্জরী
উঠছে পাতায় পাতায় কাহার করুণ নিশাস মর্মরী।
গানের পাখি গেছে উড়ে শূণ্য নীড়,
কন্ঠে আমার নাই সে আগের কথার ভিড়,
আলেয়ার এ আলোতে আর আসবে না কেউ কুল ভুলি।।

Tuesday 31 May 2011

বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি

"বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম..."
 - কাজী নজরুল ইসলাম-

আমি হব সকাল বেলার পাখি

"আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠব আমি ডাকি।

"সুয্যি মামা জাগার আগে
উঠব আমি জেগে,
'হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন',
মা বলবেন রেগে।


বলব আমি- 'আলসে মেয়ে
ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল, তাই বলে কি
সকাল হবে নাক'?

আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে ?
তোমার ছেলে উঠবে মা গো
রাত পোহাবে তবে।

Monday 30 May 2011

চল চল চল

কোরাসঃ
চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।

ঊষার দুয়ারে হানি' আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধ্যাচল।

নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!
চল রে নও-জোয়ান,
শোন রে পাতিয়া কা-
মৃত্যু-তরণ-দুয়ারে দুয়ারে
জীবনের আহবান।
ভাঙ রে ভাঙ আগল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।

জীবন-বন্দনা

গাহি তাহাদের গান-
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি' ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভ'রে ফুলে-ফলে!
বন্য শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা
যাদের শাসলে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা।
যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে
বনের ব্যাঘ্র ময়ূর সিংহ বিবরের ফণী ল'য়ে।
এল দুর্জয় গতি-বেগ-সম যারা যাযাবর-শিশু
-তারাই গাহিল নব প্রেম-গান ধরণী-মেরীর যিশু-
যাহাদের চলা লেগে
উল্কার মত ঘুরিছে ধরণী শূন্যে অমিত বেগে!

খেয়াল-খুশীতে কাটি' অরণ্য রচিয়া অমরাবতী
যাহারা করিল ধ্বংস সাধপ্ন পুনঃ চঞ্চলমতি,
জীবন-আবেগে রুধিতে না পারি' যারা উদ্ধত-শির
লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়, গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর।
নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু অভিযানে,
পক্ষ বাঁধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্বপানে!
তবুও থামে না যৌবন বেগ, জীবনের উল্লাসে
চ'লেছে চন্দ্র-মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে।
যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে
করিতেছে ফিরি, ভীম রণভূমে প্রান বাজি রেখে হারে।
আমি-মরু-কবি-গাহি সেই বেদে বেদুঈনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান।
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুন উগ্রসুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে!
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব-সম কোনো বাধা মানিল না,
বর্বর বলি' যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপ-মন্ডুক 'অসংযমী'র আখ্যা দিয়াছে যারে,
তারি তরে ভাই গান রচে' যাই, বন্দনা করি তারে।

আমি গাই তারি গান

আমি গাই তারি গান-
দৃপ্ত-দম্ভে যে যৌবন আজ ধরি' অসি খরশান
হইল বাহির অসম্ভবের অভিযানে দিকে দিকে।
লক্ষ যুগের প্রাচীন মমির পিরামিডে গেল লিখে
তাদের ভাঙার ইতিহাস-লেখা। যাহাদের নিঃশ্বাসে
জীর্ণ পুঁথির শুষ্ক পত্র উড়ে গেল এক পাশে।
যারা ভেঙে চলে অপ-দেবতার মন্দির আস্তানা,
বক-ধার্মিক নীতি-বৃদ্ধের সনাতন তাড়িখানা।
যাহাদের প্রান স্রোতে ভেসে গেল পুরাতন জঞ্জাল,
সন্সকারের জগদল-শিলা, শাস্ত্রের কঙ্কাল।
মিথ্যা মোহের পূজা-মন্ডপে যাহারা অকূতোভয়ে
এল নির্মম-মোহ-মুগদর ভাঙনের গদা ল'য়ে
বিধি-নিষেধের চীনের প্রাচীরে অসীম দুঃসাহসে
দু'-হাতে চালাল হাতুড়ি শাবল। গরস্থানেরে চ'ষে
ছুঁড়ে ফেলে যত শব কঙ্কাল বসালো ফুলের মেলা,
যাহাদের ভিড়ে মুখর আজিকে জীবনের বালি-বেলা।
-গাহি তাহাদেরি গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান।

-সেদিন নিশীথ-বেলা
দুস্তর পারাবারে যে যাত্রী একাকী ভাসালো ভেলা,
প্রভাতে সে আর ফিরিল না কূলে। সেই দুরন্ত লাগি'
আঁখি মুছি আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি'।
আজো বিনিদ্র গাহি গান আমি চেয়ে তারি পথ-পানে।
ফিরিল না প্রাতে যে জন সে-রাতে উড়িল আকাশ-যানে
নব জগতের শরসন্ধানী অসীমের পথ-চারী,
যার ভরে জাগে সদা সতর্ক মৃত্যু দুয়ারে দ্বারী!

সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভে, দিগদিগন্তে জু'ড়ে
জীবনোদ্বেগে তাড়া ক'রে ফেরে নিতি যারা মৃত্যুরে,
মানিক আহরি' আনে যারা খুঁড়ি' পাতাল যক্ষপুরী;
নাগিনীর বিষ-জ্বালা সয়ে করে ফণা হ'তে মণি চুরি।
হানিয়া বজ্র-পানির বজ্র উদ্ধত শিরে ধরি'
যাহারা চপলা মেঘ-কন্যারে করিয়াছে কিঙ্করী।
পবন যাদের ব্যজনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী,-
এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম, তাহাদের গান গাহি।
গুঞ্জরি' ফেরে ক্রন্দন মোর তাদের নিখিল ব্যেপে-
ফাঁসির রজ্জু ক্লান্ত আজিকে যাহাদের টুঁটি চেপে!
যাহাদের কারাবাসে
অতীত রাতের বন্দিনী ঊষা ঘুম টুটি' ঐ হাসে!

বর্ষা-বিদায়

ওগো বাদলের পরী!
যাবে কোন দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী।
ওগো ক্ষনিকা, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজি তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব?


তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পান্ডুর কেয়া-রেণু,
তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেণু!
কুমারীর ভীরু বেদনা-বিধুর প্রণয়-অশ্রু সম
ঝ'রিছে শিশির-সিক্ত শেফালি নিশি-ভোরে অনুপম।

ওগো ও কাজল-মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে!
কাশফুল-সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরী উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।

ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায়-পথে
কাননে কাননে কদম কেশর ঝ'রিছে প্রভাত হ'তে।
তোমার আদরে মুকুলিতা হ'য়ে উঠিল যে বল্লরী
তরুর কন্ঠে জড়াইয়া তারা কাঁদে দিবানিশি ভরি'।

'বৌ কথা-কও' পাখী
উড়ে গেছে কোথা, বাতায়নে বৃথা বউ করে ডাকাডাকি।
চাঁপার গেলাস গিয়াছে ভাঙিয়া, পিয়াসী মধুপ এসে'
কাঁদিয়া কখন গিয়াছে উড়িয়া কমল-কুমুদী-দেশে।
তুমি চ'লে যাবে দূরে,
ভাদরের নদী দু'কূল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে!

যাবে যবে দূরে হিম-গিরি-শিরে ওগো বাদলের পরী,
ব্যথা ক'রে বুক উঠিবে না কভু সেথা কাহারেও স্মরি'?
সেথা নাই জল, কঠিন তুষার, নির্মম শুভ্রতা,-
কে জানে কী ভাল বিধুর ব্যথা-না মধুর পবিত্রতা!

সেথা মহিমার ঊর্ধ্ব শিখরে নাই তরুলতা হাসি,
সেথা রজনীর রজনীগন্ধা প্রভাতে হয় না বাসি।
সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা-নুপুর খুলি'
চলিতে চকিতে চমকি' উঠ না, কবরী উঠে না দুলি'।
সেথা র'বে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিনী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি 'ফটিক-জল'।

Sunday 29 May 2011

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়
আয় রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়।।

ধুলির ধরা বেহেশ্ত আজ
জয় করিল, দিল রে লাজ,
আজকে খুশীর ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।।

দেখ আমিনা মায়ের কোলে
দোলে শিশু ইসলাম দোলে,
কচি মুখের শাহাদাতের বানী সে শোনায়।।

আজকে যত পাপী তাপি
সব গুনাহের পেল মাফি
দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী জুলুম নিল বিদায়।।

নিখিল দরুদ পড়ে ল'ইয়ে ও নাম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম
জীন পরী ফেরেশ্তা ছালাম জানায় নবীর পায়।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল

এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
শস্যশ্যামল ফসল ভরা মাটির ডালিখানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।।

তুমি কতই দিলে রতন
ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন,
ক্ষুধা পেলেই অন্ন জোগাও
মানি চাইনা মানি।।

খোদা! তোমার তোমার হুকুম তরক করি আমি অতি প্রায়,
তবু আলো দিয়ে বাতাস দিয়ে বাঁচাও এ বান্দায়।
শ্রেষ্ঠ নবী দিলে মোরে
তরিয়ে নিতে রোজ- হাশরে,
পথ না ভুলি তাই ত দিলে
পাক কোরানের বাণী।।
খোদা, তোমার মেহেরবানী।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

খোদা এই গরীবের শোন শোন মোনাজাত

খোদা এই গরীবের শোন শোন মোনাজাত
দিও তৃষ্ণা পেলে ঠান্ডা পানি, ক্ষুধা পেলে লবন- ভাত।।

মাঠে সোনার ফসল দিও
গৃহ ভরা বন্ধু প্রিয়;
আমার হৃদয় ভরা শান্তি দিও
সেই ত আমার আবে হায়াত।।

আমায় দিয়ে কারও ক্ষতি হয়না যেন দুনিয়ায়,
আমি কারো ভয় না করি, মোরেও কেহ যেন ভয় না পায়।

(যবে) মসজিদে যাই তোমারি টানে
(যেন) মন নাহি ধায় দুনিয়া- পানে,
(আমি) ঈদের চাঁদ দেখি যেন
আসলে দুঃখের আঁধার রাত।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

সাহারাতে ফুটলরে ফুল রঙ্গীন গুলে- লালা

সাহারাতে ফুটলরে ফুল রঙ্গীন গুলে- লালা
সেই ফুলেরই খোশবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা।।

সে ফুল নিয়ে কাড়াকাড়ি চাঁদ- সুরুয, গ্রহ- তারায়
ঝুঁকে পড়ে চুমে সে ফুল নীল গগন নিরালা।।

সেই ফুলেরই রওশনীতে আরশ কুর্শী রওশন,
সেই ফুলেরই রং লেগে আজ ত্রিভুবন উজালা।।

সেই ফুলেরই গুলিস্তানে আসে লাখো পাখী,
সে ফুলেরে ধরতে বুকে দোলে রে ডাল- পালা।।

চাহে সে ফুন জীন ও ইনসান হুর পরী ফেরেশতায়,
ফকীর দরবেশ বাদশাহ চাহে করতে গলে মালা।।

চেনে রসিক ভোমরা বুলবুল সেই ফুলের ঠিকানা,
কেউ বলে হযরত মোহাম্মদ কেউ বা কমলীওয়ালা।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

মোহাম্মদ নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে

মোহাম্মদ নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে।
তাই কি রে তোর কন্ঠের গান এমন মধুর লাগে।।
ওরে গোলাব নিরিবিলি
(বুঝি) নবীর কদম ছুঁইয়েছিলি
(তাই) তাঁর কদমের খোশবু আজ ও তোর আতরে জাগে।।

মোর নবীরে লুকিয়ে দেখে
তাঁর পেশানীর জ্যোতি মেখে
ওরে ও চাঁদ, রাঙ্গলী কি তুই গভীর অনুরাগে।।

ওরে ভ্রমর, তুই কি প্রথম
চুমেছিলি নবীর কদম,
আজও গুনগুনিয়ে সেই খুশী কি জানাস রে গুলবাগে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরাবী সাকী

এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরাবী সাকী
নেশায় হলাম দীওয়ানা যে, রঙ্গিন হল’ আঁখি।।

তৌহিদের সিরাজী নিয়ে
ডাকলে সবায়ঃ “যা রে পিয়ে।’’
নিখিল জগৎ ছুটে এল, রইল না কেউ বাকী।।

বসল তোমার মহফিল দূর মক্কা- মদীনাতে,
আল- কোরানের গাইলে গজল শবে কদর রাতে।

নরনারী বাদশাহ ফকির
তোমার রূপে হয়ে অধীর
যা ছিল নজরানা দিল রাঙ্গা পায়ে রাখি।।

তোমার কাসেদ খবর নিয়ে ছুটলো দিকে দিকে,
তোমার বিজয়- বার্তা গেল দেশে দেশে লিখে।

লা-শরীকের জলসাতে তাই
শরীক হল এসে সবাই
তোমার আজান- গান শুনালো হাজার বেলাল ডাকি।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

তৌহিদেরো মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম

তৌহিদেরো মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।
ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি, খোদায়ী কালাম
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।।

ঐ নামেরই রশি ধরে যাই আল্লার পথে,
ঐ নামেরই ভেলায় চড়ে ভাসি নূরের স্রোতে,
ঐ নামের বাতি জ্বেলে দেখি আরশের মোকাম
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।।

ঐ নামের দামন ধরে আছি আমার কিসের ভয়
ঐ নামের গুনে পাব আমি খোদার পরিচয়।
তাঁর কদম মোবারক যে আমার বেহেশতি তাঞ্জাম
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

আল্লাহ কে যে পাইতে চায় হযরত কে ভালবেসে

আল্লাহ কে যে পাইতে চায় হযরত কে ভালবেসে
আরশ কুর্সী লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।।

রসুল নামের রশি ধ’রে
যেতে হবে খোদার ঘরে,
নদী তরঙ্গে যে পড়েছে, ভাই
দরিয়াতে সে আপনি মেশে।।

তর্ক করে দুঃখ ছাড়া কী পেয়েছিস অবিশ্বাসী,
কী পাওয়া যায় দেখনা বারেক হযরতেমোর ভালবাসি?

এই দুনিয়ায় দিবা- রাতি
ঈদ হবে তোর নিত্য সাথী;
তুই যা চাস তাই পাবি হেথায়, আহমদ চান যদি হেসে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম মোহাম্মদ বোল

নাম মোহাম্মদ বোল রে মন, নাম মোহাম্মদ বোল
যে নাম নিয়ে চাঁদ সিতারা আসমানে খায় দোল।।

পাতায় ফুলে যে নাম আঁকা,
ত্রিভুবনে যে নাম মাখা,
যে নাম নিয়ে হাসীন ঊষার রাঙ্গে রে কপোল।।

যে নাম গেয়ে ধায়রে নদী,
যে নাম সদা গায় জলধি,
যে নাম বহে নিরবধি পবন হিল্লোল।।

যে নাম বাজে মরু সাহারায়,
যে নাম বাজে শ্রাবন- ধারায়,
যে নাম চাহে কাবার মসজিদ, মা আমিনার কোল।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমার সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।।

কুল- মখলুকে আজ ধ্বনি ওঠে,- কে এলো ঐ,
কলেমা শাহাদাতের বাণী ঠোঁটে,- কে এলো ঐ,
খোদার জ্যোতি পেশানিতে ফোটে, -কে এলো ঐ,
আকাশ গোহ তারা পড়ে লুটে- কে এলো ঐ,
পড়ে দরুদ ফেরেশতা, বেহেশতে সব দুয়ার খোলে।।

মানুষে মানুষে অধিকার দিল যে জন,
“এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই”, কহিল যে জন,
মানুষের লাগি চির –দীন বেশ ধরিল যে জন,
বাদশাহ ফকিরের এক শামিল করিল যে জন,-
এল ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী,
ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি
আজি মাতিল বিশ্ব- নিখিল মুক্তি- কলরোলে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

হেরা হ’তে হেলে দুলে

হেরা হ’তে হেলে দুলে
নুরানী তনু ও কে আসে, হায়!
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা
খুলে খুলে যায়-
সে যে আমার কামলীওয়ালা
কামলিওয়ালা।।

তার ভাবে বিভোল রাংগা পায়ের তলে
পর্বত জংগল টলমল টলে,
খোরমা খেজুর বাদাম জাফরানী ফুল
ঝ’রে ঝ’রে যায়।।
সে যে আমার কামলিওয়ালা
কামলিওয়ালা।।

আসমানে মেঘ চলে ছায়া দিতে,
পাহাড়ের অঁসু গলে ঝর্ণার পানিতে,
বিজলী চায় মালা হ’তে
পূর্ণিমা চাঁদ তাঁর মুকুট হ’তে চায়।
সে যে আমার কামলীওয়ালা
কামলিওয়ালা।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

যাবি কে মদিনায়

যাবি কে মদিনায়, আয় ত্বরা করি।
তোর খেয়া- ঘাটে এল পুন্য- তরী।।

আবু বকর উমর খাত্তাব
আর উসমান, আলী হায়দা্
দাঁড়ি এ সোনার তরণীর,
পাপী সব নাই নাই আর ডর।

এ তরীর কান্দারী আহমদ,
পাকা সব মাঝি ও মাল্লা,
মাঝিদের মুখে সারি-গান
শোন ঐ “লা শরীক আল্লাহ!’’
মোরা পাপ দরিয়ার তুফানে আর নাহি ডরি।।

শাফায়ত- পাল ওড়ে তরীর
অনুকূল হাওয়ার ভরে,
ফেরেশতা টানিছে তার গুন,
ভিড়িবে বেহেশতী-চরে।।

ঈমানের পারানী কড়ি আছে যার
আয় এ সোনার নায়,
ধরিয়া দীনের রশি
কলেমার জাহাজ- ঘাটায়।
ফেরদৌস হ’তে ডাকে হুর পরী।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

হে মদিনার নাইয়া

হে মদিনার নাইয়া! ভব- নদীর তুফান ভারি
কর কর পার।
তোমার দয়ায় ত’রে গেল লাখো গুনাহগার
কর কর পার।।

পারের কড়ি নাই যে আমার হয়নি নামাজ রোযা
আমি কূলে এসে বসে, আছি নিয়ে পাপের বোঝা,
ইয়্যা রাসুল মোহাম্মদ বলে কাঁদি বারেবার।।

তোমার নাম গেয়েছি শুধু কেঁদে সুবহ শাম,
মোর তরিবার আর নাই ত পুঁজি বনা তোমার নাম।

আমি হাজারো বার দরিয়াতে ডু’বে যদি মরি
ছাড়বোনা মোর পারের আশা, তোমার চরন –ত্রী,
দেখো সবার শেষে পার যেন হয় এই খিদমতগার।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

যে দুর্দিনের নেমেছে বাদল

যে দুর্দিনের নেমেছে বাদল তাহারি বজ্র শিরে ধরি
ঝড়ের বন্ধু, আঁধার নিশীথে ভাসায়েছি মোরা ভাঙ্গা তরী।।

মোদের পথের উঙ্গিত ঝলে বাঁকা বিদ্যুতে কালো মেঘে,
মরু পথে জাগে নব অঙ্কুর মোদের চলার ছোঁওয়া লেগে,
মোদের মন্ত্রে গোরস্থানে আঁধারে ওঠে গো প্রান জেগে,
দীপ-শলাকার মত মোরা ফিরি ঘরে ঘরে আলো সঞ্চরি।।

নব জীবনের ‘ফোরাত’-কুলে গো কাঁদে ‘কারবালা’ তৃষ্ণাতুর,
উর্ধ্বে শোষন- সূর্য, নিম্নে তপ্ত বালুকা ব্যথা-মরুর।
ঘিরিয়া ইউরোপ- এজিদের সেনা এপার ওপার নিকট, দূর,
এরি মাঝে মোরা ‘আব্বাস’ সম পানি আনি প্রানপন করি।।

যখন জালিম ‘ফেরাউন’ চাহে ‘মুসা’ ও সত্যে মারিতে ভাই,
নীল দরিয়ার মোরা তরঙ্গ বন্যা আনিয়া তারে ডুবাই।
আজো নমরুদ ইসবরাহীমেরে মারিতে চাহিছে সর্বদাই,
আনন্দ- দূত মোরা সে আগুনে ফোটাই পুশপ- মঞ্জরী।।

ভরসার গান শুনাই আমরা ভয়ের ভুতের এই দেশে,
জরা- জীর্ণের যৌবনে দিয়া সাজাই নবীন বর- বেশে।
মোদের আশার ঊষার রঙ্গে গো রাতের অশ্রু যায় ভেসে,
মশাল জ্বালিয়া আলোকিত করি ঝড়ের নিশীথ- শর্বরী।।

নতুন দিনের নব জাত্রিরা চলিবে বলিয়া এই পথে
বিছাইয়া যাই আমাদের প্রান, সুখ, দুখ, সব আজি হতে।
ভবিশ্যতের স্বাধীন- পতাকা উড়ীবে যেদিন জয় রথে
আমরা হাসিব দূর তারা- লোকে অগো তোমাদের সুখ স্মরি।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

তওফিক দাও খোদা

তওফিক দাও খোদা
মুসলিম- জাহাঁ পুনঃ হক আবাদ।
দাও সেই হারানো সুলতানত,
দাও সেই বাহু, সেই দিল আযাদ।।

দাও সেই হামজা সেই বীর অলীদ
দাও সেই ওমর হারুন আল রশিদ
দাও সেই সালাহউদ্দিন আবার
পাপ দুনিয়াতে চলুক জেহাদ।।

দাও বে-দেরেগ তেগ জুলফিকার
খয়রব জয়ীশেরে- খেদার,
দাও সে খলিফা সে হাশমাত
দাও সে মদিনা সে বাগদাদ।।

দাও সেই হামজা সেই বীর অলীদ
দাও সেই ওমর হারুন আল রশিদ
দাও সেই সালাহউদ্দিন আবার
পাপ দুনিয়াতে চলুক জেহাদ।।

দাও সে রুমী সাদী হাফিজ
সেই জামী খৈয়াম সে তবরিজ;
দাও সে বাবর সেই শাহজাহান
সেই তাজমহলের স্বপ্ন সাধ।।

দাও ভায়ে ভায়ে সেই মিলন
সেই স্বার্থত্যাগ সেই দৃপ্ত মন,
হোক বিশ্ব- মুসলিম এক জামাত
উড়ুক নিশান ফের যুক্ত চাঁদ।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

বাজল কিরে ভোরের সানাই

বাজল কিরে ভোরের সানাই
নিঁদ মহলার আঁধার পুরে!
শুনছি আজান গগন তলে
অতীত রাতের মিনার চূড়ে।।

সরাই-খানার যাত্রিরা কি
“বন্ধু জাগো” উঠলো হাঁকি?
নীড় ছেড়ে ঐ প্রভাত পাখী
গুলিস্তানে চলল উড়ে।।

আজ কি আবার কাবার পথে
ভীড় জমেছে প্রভাত হ’তে;
নামল কি ফের হাজার স্রোতে
‘হেরার জ্যোতি জগত জুড়ে।।

আবার খালিদ তারিক মুসা
আনল কি খুন- রঙ্গিন ভূষা,
আসল ছুটে হাসী ঊষা
নও বিলালের শিরীন সুরে।।

তীর্থ পথিক দেশ বিদেশের
আরফাতে আজ জুতল কি ফের
“লা শরীক আল্লাহু”- মন্ত্রের
নাম্ল কি বান পাহাড় তুরে।।

আঁজলা ভ’রে আনল কি প্রান
কারবালাতে বির শহীদান,
আজকে রওশন জমীন আসমান
নও জাওয়ানির সুরখ নূরে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

দেশে দেশে গেয়ে বেড়াই

দেশে দেশে গেয়ে বেড়াই তোমার নামের গান
হে খোদা, এ যে তোমার হুকুম, তোমারই ফরমান।।

এমনি তোমার নামের আছর
নামাজ রোজার নাই অবসর।
তোমার নামের নেশায় সদা মশগুল মোর প্রান।

তকদিরে মোর এই লিখেছ-
হাজার গানের সুরে
নিত্য দিব তমার আজান
আঁধার মিনার চূড়ে।

কাজের মাঝে হাটে পথে
রণ- ভূমে এবাদতে
আমি তোমার নাম শোনাব, করবো শক্তি দান।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

আমার যখন পথ ফুরাবে

আমার যখন পথ ফুরাবে,
আসবে গহীন রাতি-
তখন তুমি হাত ধরে মর
হয়ো পথের সাথী।।

অনেক কথা হয়নি বলা,
বলার সময় দিও ( খোদা),
আমার তিমির অন্ধ চোখে
দৃষ্টি দিও প্রিয় ( খোদা);
বিরাজ করো বুকে আমার
আরশখানি পাতি।।

সারা জীবন কাটলো আমার
বিরহে, বধুঁ
পিপাসিত কন্ঠে এসে
দিও মিলন মধু।

তুমি যেথায় থাকো প্রিয়,
সেথায় যেন যাই (খোদা)।
সখা বলে দেকো আমায়,
দীদার যেন পাই (খোদা);
সারা জনম দুঃখ পেলাম,
(যেনো) এবার সুখে মাতি।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

শোনো শোনো ইয়া এলাহী

শোনো শোনো ইয়া এলাহী
আমার মুনাজাত।
তোমারি নাম জপে যেন
হৃদয় দিবস- রাত।।

যেন শুনি কানে সদা
তোমারি কালাম, হে খোদা,
চোখে শুধু দেখি যেন
কোরানের আয়াত।।

মুখে যেন জপি আমি
কলমা তোমার দিবস- যামী,
(তোমার) মসজিদেরই ঝাড়ু- বর্দার
হোক আমার এ হাত।।

সুখে তুমি, দুখে তুমি,
চোখে তুমি, বুকে তুমি,
এই পিয়াসী প্রানের খোদা
তুমিই আবে- হায়াত।।

- কাজী নজরুল ইসলাম-

শোনো শোনো মোনাজাত

খোদা এই গরীবের শোনো শোনো মোনাজাত
দিও তৃষ্ণা পেলে ঠান্ডা পানি, ক্ষুধা পেলে লবন- ভাত।।

মাঠে সোনার ফসল দিও
গৃহ ভরা বন্ধু প্রিয়,
আমার হৃদয় ভরা শান্তি দিও
সেই ত আমার আবেহায়াত।।

আমায় দিয়ে কারো ক্ষতি হয় না যেন দুনিয়ায়
আমি কারুর ভয় না করি, মোরে কেহ ভয় না পায়।

(যাবে) মসজিদে যাই তোমার টানে
(যেন) মন নাহি যায় দুনিয়া - পানে,
(আমি) ঈদের চাঁদ দেখি যেন
আসলে দুখের আঁধার রাত।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

যেদিন তুমি হবে কাজী

যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার
তুমি হবে কাজী,
সেদিন তোমার দীদার আমি
পাব কি আল্লাজী

সেদিন নাকি তোমার ভীষোন কাহহার রূপ দেখে
পীর পয়গম্বর কাঁদবে ভয়ে 'ইয়া নাফসি' ডেকে।
সেই সুদিনের আশায় আমি নাচি এখন থেকে।
আমি তোমায় দেখে হাজার বার দোজখ যেতে রাজী।।

যে রূপে হোক বারেক যদি দেখে তোমায় কেহ,
দোজখ কি আর ছুঁতে পারে পবিত্র তার দেহ।
সে হোক না কেন হাজার পাপী হোক না বে- নামাজী।।

ইয়া আল্লাহ, তোমার দয়া কত, তাই দেখাবে ব'লে
রোজ হাশরে দেখা দেবে বিচার করার ছলে।
প্রেমিক বিনে কে বুঝিবে তোমার এ কারসাজী।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

আল্লাহ আমার করো না বিচার

রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার।
বিচার চাহি না, তোমার দয়া চাহে এ গুনাহগার।।

আমি জেনে শুনে জীবন ভরে
দোষ করেছি ঘরে পরে,

আশা নাই যে ত'রে যাব বিচারে তোমার।।

বিচার যদি করবে কেন রহমান নাম নিলে।
ঐ নামের গুনেই তরে যাব, কেন এ জ্ঞান দিলে।।

দীন- ভিখারী ব'লে আমি
ভিক্ষা যখন চাইব, স্বামী,
শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে, পারবে না কো আর।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

দীন- দরিদ্র কাঙ্গালের তরে

দীন- দরিদ্র কাঙ্গালের তরে এই দুনিয়ায় আসি'
হে হযরত, বাদশাহ হ'য়ে ছিলে তুমি উপবাসী।।

তুমি চাহ নাই কেহ হইবে আমীর, পথের ফকীর কেহ,
কেহ মাথা গুঁজিবার পাইবে না ঠাঁই, কাহারো সোনার গেহ,
ক্ষুধার অন্ন পাইবে না কেহ, কারো শত দাস দাসী।।

আজ মানুষের ব্যথা অভাবের কথা ভাবিবার কেহ নাই,
ধনী মুসলিম ভোগ ও বিলাসে ডুবিয়া আছে সদাই,
তাই তোমারেই ডাকে যত মুসলিম গরীব শ্রমিক চাষী।
বঞ্চিত মোরা হইয়াছি আজ তব রহমত হ'তে,
সাহেবী গিয়াছে, মোসাহেবী করি' ফিরি দুনিয়ার পথে,
আবার মানুষ হব কবে মোরা মানুষেরে ভালোবাসি।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

নামে মোবারক মোহাম্মদ

ইসলামের ঐ সওদা লইয়ে এল নবীন সওদাগর।
বদনসীব আয়, আয় গুনাহগার নতুন ক'রে সওদা কর।।

জীবন ভরে করলি লোকসান আজ হিসাব তার খিতিয়ে নে,
বিনি মুলে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহেশতি নজর।।

কোরানের ঐ জাহাজ বোঝাই হীরা মুক্তা পান্নাতে,
লুটে নে রে লুটে নে সব ভরে তোল তোর শূন্য ঘর।।

কালেমার ঐ কানাকড়ির বদলে দেয় এই বনিক
শাফায়াতের সাত রাজার ধন, কে নিবি আয় ত্বরা কর।।

কিয়ামতের বাজারে ভাই মুনাফা যে চাও বহুৎ,
এই ব্যাপারীর হও খরিদ্দার লও রে ইহার সীলমোহর।।

আরশ হ'তে পথ ভুলে এ এল মদীনা শহর,
নামে মোবারক মোহাম্মদ, পূঁজি আল্লাহু আকবর।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

নিখিল প্রেমাস্পদ

আসিছেন হাবীবে খোদা, আরশ পাকে তাই উঠেছে শোর,
চাঁদ পিয়াসে ছুটে' আসে আকাশ- পানে যেমন চকোর,
কোকিল যেমন গেয়ে উঠে ফাগুম আসার আভাস পেয়ে,
তেমনি করে হরষিত ফেরেশতা সব উঠলো গেয়ে,-
দেখ আজ আরশে আসেন মোদের নবী কামলীওয়ালা
হের সেই খুশীতে চাঁদ- সুরুজ আজ হল দ্বিগুন আলা।।

ফকির দরবেশ আউলিয়া যাঁরে
ধ্যানে জ্ঞানে ধরতে নারে,
যাঁর মহিমা বুঝতে পারে
এক সে আল্লাহতালা।।

বারেক মুখে নিলে যাঁহার নাম
চিরতরে হয় দোযখ হারাম,
পাপীর তরে দস্তে যাঁহার
কাওসারের পেয়ালা।।

মিম হরফ না থাকলে যে আহাদ
নামে মাখা যার শিরীন শহদ,
নিখিল প্রেমাস্পদ আমার মোহাম্মদ
ত্রিভুবন উজালা।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

রাহে কাবা

ইয়া রাসুলুল্লাহ! মোরে রাহা দেখাও সেই কাবার-
যে কাবা মসজিদে গেলে পাব আল্লার দীদার।।

দ্বীন- দুনিয়া এক হয়ে যায় যে কাবার ফজিলতে,
যে কাবাতে হাজী হলে রাজী হন পরওয়ারদিগার।।

যে কাবার দুয়ারে জামে- তৌহিদ দেন হযরত আলী,
যে কাবায় কুল- মাগফেরাতে কর তুমি ইন্তেজার।।

যে কাবাতে গেলে দেখি কুর্শী লওহ কালাম,
মরণে আর ভয় থাকেনা, হাসিয়া হয় বেড়া পার।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

বাদশার ও বাদশাহ

মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লেআলা
তুমি বাদশারও বাদশাহ কামলিওয়ালা।।

পাপে-তাপে পূর্ণ আঁধার দুনিয়া
হ'ল পূন্য বেহেশতী নূরে উজালা।।

গুনাহগার উম্মত লাগি' তব
আজো চয়ন নাহি, কাঁদিছ নিরালা।।

কিয়ামতে পিয়াসী উম্মত লাগি,
দাড়ায়ে র'বে লয়ে তহুরার পিয়ালা।।

জ্বলিবে হাশর দিনে দ্বাদশ রবি,
নফসি নফসি কবে সকল নবী
ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি একেলা তুমি,
কাঁদিবে খোদার পার আর্শ চুমি'-
পাপী উম্মত ত্রান তব জপমালা।।

করে আউলিয়া আম্বিয়া তোমারি ধ্যান,
তব গুণ গাহিল খোদ আল্লাহতায়ালা।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

আমার প্রিয় হযরত

আমার প্রিয় হযরত নবী কামলিওয়ালা।।
যাঁহার রওশনীতে দ্বীন- দুনিয়া উজালা।।

যাঁরে খুঁজে ফেরে কটি গ্রহ তারা,
ঈদের চাঁদে যাঁহার নামের ইশারা,
বাগিচায় গোলাব গুল গাঁথে যাঁর মালা।।

আউলিয়া আম্বিয়া দরবেশ যাঁর নাম
খোদার নামের পরে জপে অবিরাম,
কেয়ামতে যাঁর হাতে কাওসার পিয়ালা।।

পাপে মগ্ন ধরা যাঁর ফজিলতে
ভাসিল সুমধুর তৌহিদ- স্রোতে,
মহিমা যাঁহার জানেন এক আল্লাহতায়ালা।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

খোদার বন্ধু

সৈয়দে মক্কী মাদানী আমার নবী মোহাম্মদ।
করুনাসিন্ধু খোদার বন্ধু নিখিল মানব প্রেমাস্পদ।।

আদম নূহ ইবরাহীম দাউদ সলেমান মুসা আর ঈসা,
সাক্ষ্য দিল আমার নবীর, তা'দের কালাম হ'ল রদ।।

যাঁহার মাঝে দেখল জগৎ ইশারা খোদার নূরের,
পাপ দুনিয়ায় আনল যে রে পুণ্য বেহেশতী সনদ।।

হায় সেকান্দর খুঁজল বৃথাই আব হায়াত এই দুনিয়ায়
বিলিয়ে দিল আমার নবী সে সুধা মানব সবায়।।

হায় জুলেখা মজল বৃথাই ইউসুফের ওই রূপ দেখে,
দেখলে আমার নবীর সুরত যোগীন হত ভসম মেখে।
শুনলে নবীর শিরীন জবান, দাউদ মাগিত মদদ।।

ছিল নবীর নূর পেশানিতে তাই ডুবল না কিশতী নূহের,
পুড়ল না আগুনে হযরত ইবরাহিম সে নমরুদের,
বাঁচল ইউনুস মাছের পেটে স্মরণ ক'রে নবীর পদ;
দোযখ আমার হারাম হ'ল
পিয়ে কোরানের শিরীন শহদ।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

সুদূর মক্কা মদিনার পথে

সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির,
বিরাজে রওজা মোবারক যথা মোর প্রিয় নবীজীর।।
বাতাসে যেখানে বাজে অবিরাম
তৌহিদ বাণী খোদার কালাম,
জিয়ারতে যথা আসে ফেরেশতা শত আউলিয়া পীর।।

মা ফাতেমা আর হাসান হোসেন খেলেছে পথে যার
কদমের ধূলি পড়েছে যেথায় হাজার আম্বিয়ার,
সুরমা করিয়া কবে সে ধূলি
মাখিব নয়নে দুই হাতে তুলি,
কবে এ দুনিয়া হ'তে যাবার আগে রে কাবাতে লুটাব শির।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

সালাম

কাবার জিয়ারতে তুমি কে যাও মদিনায়?
আমার সালাম পৌঁছে দিও নবীজীর রওজায়।।

হাজীদের ওই যাত্রা পথে
দাঁড়িয়ে আছি সকাল হ'তে,
কেঁদে বলি, কেউ যদি মোর
সালাম নিয়ে যায়।।

পঙ্গু আমি, আরব সাগর লঙ্ঘি কেমন করে,
তাই নিশিদিন কা'বা যাওয়ার পথে থাকি পড়ে।

বলি, ওরে দরিয়ার ঢেউ,
(মোর) সালাম নিয়ে গেল না কেউ,
তুই দিস মোর সালামখানি
মরুর 'লু' হাওয়ায়।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

পাঠাও বেহেশত হতে

পাঠাও বেহেশত হতে, পুনঃ সাম্যের বাণী,
(আর) দেখিতে পারি না মানুষে মানুষে এই হীন হানাহানি।।

বলিয়া পাঠাও, হে হযরত,
যাহারা তোমার প্রিয় উম্মত,
সকল মানুষে বাসে তারা ভালো খোদার সৃষ্টি জানি।
সবারে খোদারই সৃষ্টি জানি।।

অর্ধেক পৃথিবী আনিল ঈমান যে উদারতা- গুনে
(তোমার) যে উদারতা- গুনে,
শিখিনি আমরা সে উদারতা, কেবলি গেলাম শুনে
কোরানে হাদিসে কেবলি গেলাম শুনে।
তোমার আদেশ অমান্য ক'রে
লাঞ্চিত মোরা ত্রিভুবন ভ'রে,
আতুর মানুষে হেলা ক'রে বলি, "আমরা খোদারে মানি"।।

- কাজী নজরুল ইসলাম-

দূর আরবের স্বপন দেখি

দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে।
বেহুঁশ হ'য়ে চলেছি যেন কেঁদে কেঁদে কাবার পথে।
হায় গো খোদা, কেন মোরে
পাঠাইলে কাঙ্গাল ক'রে,
যেতে নারি প্রিয় নবীর মাজার শরিফ জিয়ারতে।।

স্বপ্নে শুনি নিতুই রাতে যেন কা'বার মিনার থেকে
কাঁদছে বেলাল ঘুমন্ত সব মুসলিমেরে ডেকে' ডেকে'।
ইয়া এলাহি! বল সে কবে
আমার স্বপন সফল হ'বে,
আমি গরীব ব'লে হব কি নিরাশ মদিনা দেখার নিয়ামতে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া

নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া
কে এলো মক্কায় আমিনার কোলে।
ফাগুন পূর্ণিমা- নিশীথে যেমন
আসমানের কোলে রাঙ্গা চাঁদ দোলে।।

কে এলো কে এলো গাহে কোয়েলিয়া,
পাপিয়া বুলবুল উঠিল মাতিয়া,
গ্রহ তারা ঝুঁকে করিছে কুর্নিশ,
হুরপরী হেসে পড়িছে ঢলে।।

জান্নাতের আজ খোলা দরওয়াজা পেয়ে
ফেরেশতা আম্বিয়া এসেছে ধেয়ে
তহরীমা বেঁধে ঘোরে দরুদ গেয়ে
দুনিয়া টলমল, খোদার আরশ টলে।।

এল রে চির- চাওয়া, এল আখেরী- নবী
সৈয়দে মক্কী মাদানী আল আরাবী,
নাজেল হয়ে সে যে ইয়াকুত- রাঙ্গা ঠোঁটে
শাহাদাতের বাণী আধো আধো বোলে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

তুমি অনেক দিলে খোদা

তুমি অনেক দিলে খোদা,
দিলে অশেষ নেয়ামত।
আমি লোভী, তাইতো আমার
মিটেনা হসরতে।।

কেবলই পাপ করি আমি,
মাফ করিতে তাই, হে স্বামী!
দয়া করে শ্রেষ্ঠ নবীর করিলে উম্মত।
তুমি নানান ছলে করছ পূরণ ক্ষতির খেসারত।।

মায়ের বুকে স্তন্য দিলে, পিতার বুকে স্নেহ,
মাঠে শস্য- ফসল দিলে, আরাম লাগি গেহ।

কোরান দিলে পথ দেখাতে,
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেখাতে,
নামায দিয়ে দেখাইলে মসজিদেরই পথ।
তুমি কেয়ামতের শেষে দিবে বেহেশতী দৌলত।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই

মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।

আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
গোর - আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।।

কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত
ঐ মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত।
সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই।।

কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে
আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে,
আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে
(আল্লার নাম জপতে চাই) ।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

আল্লাহ আমার প্রভু

ভৈরবী- কার্ফা)

আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়।
আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।।

আমার কিসের শঙ্কা,
কোরান আমার ডঙ্কা
ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।।

কালেমা আমার তাবিজ, তৌহিদ আমার মুর্শিদ,
ঈমান আমার ধর্ম, হেলাল আমার খুর্শিদ।
'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি
আমার জেহাদ- বাণী?
আখের মোকাম ফেরদৌস খোদার আরশ যেথায় রয়।।

আরব মেসের চীন হিন্দ মুসলিম- জাহান মোর ভাই,
কেহ নয় উচ্চ কেহ নীচ, এখানে সমান সবাই।
এক দেহ এক দিল এক প্রান,
আমীর ফকির এক সমান,
এক তকবীরে উঠি জেগে, আমার হবেই হবে জয়।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

উম্মত আমি গুনাহগার

(সুন্ধু ভৈরবী- কার্ফা)

উম্মত আমি গুনাহগার
তবু ভয় নাহি রে আমার
আহমদ আমার নবী
যিনি খোদ হাবিব খোদার।।

যাঁহার উম্মত হতে চাহে সকল নবী,
তাহারি দামন ধরি' পুলসিরাত হব পার।।

কাঁদিবে রোজ হাশরে সবে
যবে নাফসি ইয়া নাফসি রবে,
ইয়া উম্মতী বলে একা কাঁদিবেন আমার মোখতার।।

কাঁদিবেন সাথে মা ফাতিমা ধরিয়া আরশ আল্লার
হোসায়েনের খুনের বদলায় মাফী চাই পাপী সবাকার।।

দোযখ হয়েছে হারাম যে দিন পড়েছি কালেমা,
যেদিন হয়েছি আমি কোরানের নিশান- বর্দার।।

(গুল বাগিচা)- কাজী নজরুল ইসলাম-

অনুরোধ

পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া।
যাও রে বইয়া এই গরীবের সালামখানি লইয়া।।

কাবার জিয়ারতের আমার নাই সম্বল ভাই,
সারা জনম সাধ ছিল যে, মদিনাতে যাই ( রে ভাই)।
মিটল না সাধ, দিন গেল মোর দুনিয়ার বোঝা বইয়া।।

তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি,
লইয়া যাওরে এই নিরাশের দীর্ঘ নিশ্বাসখানি।
নবীজীর রওজায় কাঁদিও ভাই রে আমার হইয়া।।

মা ফাতেমা হযরত আলীর মাজার যেথায় আছে,
আমার সালাম দিয়া আইস তাঁদের পায়ের কাছে।
কাবায় মোজানাজাত করিও আমার কথা কইয়া।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

জাগো মুসাফির

ভোর হল, ওঠ জাগো মুসাফির, আল্লা - রাসুল বোল
গাফলিয়াতি ভোল রে অলস, আয়েশ আরাম ভোল।।

এই দুনিয়ার সরাইখানায়
(তোর) জনম গেল ঘুমিয়ে হায়!
ওঠ রে সুখশয্যা ছেড়ে, মায়ার বাঁধন খোল।।

দিন ফুরিয়ে এল যে রে দিনে দিনে তর
দিনের কাজে অবহেলা করলি জীবনভোর।।

যে দিন আজো আছে বাকী
খোদারে তুই দিসনে ফাঁকি
আখেরে পার হবি যদি পুলসিরাতের পোল।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

বক্ষে আমার কাবার ছবি

বক্ষে আমার কাবার ছবি,
চক্ষে মোহাম্মদ রাসুল।
শিরোপরি মোর খদার আরশ
গাই তারি গান পথ বেভুল।।

পাইলির প্রেমে মজনু পাগল,
আমি পাগল 'লা- ইলা'র,
প্রেমিক দরবেশ আমায় চিনে
অ-রসিকে কয় বাতুল।।

হৃদয়ে মোর খুশীর বাগান,
বুলবুলি তায় গায় সদাই-
ওরা খোদার রহম মাগে
আমি খোদার 'ইশক' চাই।।


আমার মনের মসজিদে দেয়
আজান হাজার 'মুয়াজ্জিন',
প্রানের 'লওহে' কোরান লেখা
'রুহ' পড়ে তা রাত্রিদিন।

খাতুনি জিন্নত আমার মা,
হাসান হোসেন চোখের জল,
ভয় করিনা রোজ- কিয়ামত
পুল- সিরাতের কঠিন পুল।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

কোথা সে মুসলমান

আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান।
কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবন- মৃত্য- জ্ঞান।।

যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম;
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জ্বীন পরী ইনসান।।

স্ত্রী- পুত্ররে আল্লারে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক
সেহে কোরবানী দিত প্রান, হায়! আজ তারা মাগে বিখ।

কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা,
আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে ল'য়ে কোরান।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

তুইও ওঠ জেগে

দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে দীন ই ইসলামী লাল মশাল।
ওরে বে- খবর, তুইও ওঠ জেগে তুইও তোর প্রান প্রদ্বীপ জ্বাল।।

গাজী মুস্তাফা কামালের সাথে জেগেছে তুর্কী সুর্খ- তাজ,
রেজা পহলবী সাথে জাগিয়াছে বিরান মূলুক ইরানও আজ,
গোলামী বিসরি' জেগেছে মিসরী, জগলুল সাথে প্রান- মাতাল।।

ভুলি গ্লানি' লাজ জেগেছে হেজাজ নেজদ আরবে ইবনে সউদ,
আমানুল্লার পরশে জেগেছে কাবুলে নবীন আল- মাহ্মুদ,
মরা মরক্কো বাঁচাইয়া আজ বন্দী করিম রীফ- কামাল।

জাগে ফয়স্ম ইরাক আজম, জাগে নব হারুন -অল- রশীদ,
জাগে বায়তুল মোকাদ্দস রে, জাগে শাম দেখ টুটিয়া নিঁদ,
জাগো নাকো শুধু হিন্দের দশ কোটি মুসলিম বে- খেয়াল।।

মোরা আসহাব- কাহাফের মত হাজারো বছর শুধু ঘুমাই,
আমাদের কেহ ছিল বাদশাহ কোন কালে, তারি করি বড়াই,
জাগি যদি মোরা, দুনিয়া আবার কাঁপিবে চরণে টাল- মাটাল।।

(জুলফিকার) -কাজী নজরুল ইসলাম-

শহীদী ইদগাহ

শহীদী ঈদগাহ দেখ আজ জমায়েত ভারি।।
হবে দুনিয়াতে আবার ইসলামী ফরমান জারি।।
তুরান ইরান হেজাজ মেসের হিন্দ মরক্কো ইরাক,
হাতে হাত মিলিয়ে আজ দাঁড়ায়েছে সারি সারি।।

ছিল বেহুঁশ যারা আঁসু ও আফসোস লঁইয়ে,
চাহে ফেরদৌস তারা জেগেছে নও জোশ ল'ইয়ে।
তুইও আয় এই জমাতে ভুলে যা দুনিয়াদারী।।

ছিল জিন্দানে যারা আজকে তারা জিন্দা হয়ে
ছোটে ময়দানে দারাজ- দিন আজি শমশের লয়ে।
তকদীর বদলেছে আজ উঠিছে তকবির তারি।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

ফাতেমা দুলাল কাঁদে

ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে।
দু'হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে।।

দুধের ছাওয়াল আসগর এই পানি ছাহিয়ে রে
দুষ্মনের তীর খেয়ে বুকে ঘুমাল খুন পিয়ে রে,
শাদীর নওশা কাসেম শহীদ এই পানি বহনে রে।।

এই পানিতে মুছিল রে হাতের মেহেদী সকীনার,
এই পানিরই ঢেউয়ে ওঠে তারি মাতম হাহাকার,
শহীদানের খুন মিশে আছে এই পানিরই সনে রে।।

বীর আব্বাসের বাজু শহীদ হলো এরি তরে রে,
এই পানি বিহনে জয়নাল খিমায় তৃষ্ণায় মরে রে,
শোকে শহীদ হলেন হোসেন জয়ী হয়েও রণে রে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

চাষীর গীত (১)

চাষ কর দেহ- জমিতে।
হবে নানা ফসল এতে।।

নামাযে জমি 'উগালে',
রোজাতে জমি 'সামালে',
কলেমায় জমিতে মই দিরে
চিন্তা কি হে এই ভবেতে।।

লা- ইলাহা ইল্লাল্লাতে
বীজ ফেল তুই বিধি মতে,
পাবি 'ঈমান' ফসল তাতে
আর রইবি সুখেতে।।

নয়টা নালা আছে তাহার
অজুর পানি নিয়াত যাহার,
ফল পানি নানা প্রকার
ফসল জন্মিবে তাহাতে।।

যদি ভাল হয় হে জমি
হজ্জ জাকাত লাগাও তুমি,
আরো সুখে থাকবে তুমি-
কয় নজরুল ইসলামেতে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

আল্লা রাসুল জপের গুণে

আল্লা রাসুল জপের গুণে কি হল দেখ চেয়ে
সদাই ঈদের দিনের খুশীতে তোর পরাণ আছে ছেয়ে।।

আল্লার রহমত ঝরে
ঘরে বাইরে তোর উপরে,
আল্লা রাসুল হয়েছেন তোর জীবন- তরীর নেয়ে।।

দুখে সুখে সমান খুশী, নাই ভাবনা ভয়,
(তুই) দুনিয়াদারী করিস, তবু আল্লাতে মন রয়।

মরণকে আর ভয় নাই তোর,
খোদার প্রেমে পরাণ বিভোর,
(এখন) তিনিই দেখেন তোর সংসার তোর ছেলেমেয়ে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

আল্লাহ রাসুল তরু আর ফুল

আল্লা রাসুল তরু আর ফুল প্রেমিক হৃদয় জানে
কেহ বা তরু রে ভালবাসে ভাই, কেহ ফুল ধরে টানে।।

কেহ বা ফুলের মধু চায়, কেহ চায় সে গাছের ছায়া
গাছের ছায়ায় জুড়াইয়া পায় গুল সুবাসের মায়া।
তরু ছুঁইয়ে বোঝে আল্লা রাসুলে রসলীলা কোনখানে।।

কোন জন চাহে গুলের খুশবু কোন জন চাহে গুল,
খুশবুর সাথে ফুলেরেও চাহে প্রেমিক যে বুলবুল।
জালালের সাথে জামালেও চাহে, প্রেমিক যে বুলবুল।।

আল্লারে ভালবেসে যার গেছে সকল দ্বিধা ও ভয়
রাসুল তাহারে প্রেম দিয়ে কন, আল্লা যে প্রেমময়।
তিনি যে কেবল বিচারক নন, আল্লা যে প্রেমময়,
মজনুর মত দিওয়ানা সে যে লাইলার মধুপানে।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

তোমায় যেমন করে ডেকেছিল

তোমায় যেমন করে ডেকেছিল আরব মরুভূমি;
ওগো আমার নবী প্রিয় আল আরাবী,
তেমনি করে ডাকি যদি আসবে নাকি তুমি।।

যেমন কেঁদে দজলা ফোরাত নদী
ডেকেছিল নিরবধি,
হে মোর মরুচারী নবুয়তধারী,
তেমনি করে কাঁদি যদি আসবে নাকি তুমি।।

যেমন মদিনা আর হেরা পাহাড়
জেগেছিল আশায় তোমার
হে হযরত মম, হে মোর প্রিয়তম,
তেমনি করে জাগি যদি আসবে নাকি তুমি।।

মজলুমেরা কাবা ঘরে
কেঁদেছিল যেমন করে,
হে আমিনা- লালা, হে মোর কামলীওয়ালা,
তেমনি করে চাহি যদি আসবে নাকি তুমি।।

- কাজী নজরুল ইসলাম-

Wednesday 25 May 2011

নজরুল প্রতিভাঃ বাবু রহমান

কাজী নজরুল ইসলামের সৌভাগ্য, তিনি যখন কর্মে মগ্ন তখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে। আর যখন বাকরুদ্ধ হলেন- তখন প্রচারের বাইরে; এক সময় তা অন্ধবিবরে। কবির জীবিত অবস্থায় দিল্লী থেকে ১৯৩৮ সালে আখতার হোসেন রায়পুরী’র অনুবাদে ‘পীয়াম-ই-শাহাব’ শীর্ষক উর্দু ভাষায় নজরুল কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। জানা যায়, ছান্দসিক আব্দুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনা করেছেন কবির জীবদ্দশায়।



নজরুল চর্চার অন্ধকার যুগে–১৯৪৯ সালে, মহামানব কাজী আব্দুল ওদুদের (১৮৯৪-১৯৭০) কোলকাতার বর্মণ পাবলিশিং থেকে ‘নজরুল প্রতিভা’ নামে মূল্যায়নমূলক একটি চটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী রচিত ‘নজরুল সাহিত্যের ভূমিকা’ নামে ‘পাকিস্তান বুক স্টল’ থেকে আর একটি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘদিন দুষ্প্রাপ্যের খাতায় নাম রেখে নজরুল জন্মশতবর্ষে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে এর ২য় সংস্করণ হয়। ১৯৬২ সালে শহীদ আমীর হোসেন চৌধুরী রচিত নজরুল কাব্যে রাজনীতি গ্রন্থটি বহুকাল পর ‘আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরাম’ থেকে বের হয়।

আর নজরুলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৪টি গীতিগ্রন্থ এবং ৩টি স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে দুই বাংলায় নজরুল প্রায় বিশ বছর অনুপস্থিত। অবশ্য তথাকথিত পাকিস্তানে (বাংলাদেশের নাম বদল করে) মানুষ নজরুলকে ভারত থেকে আগত এক শ্রেণীর মোহাজের মুসলিম নজরুল প্রয়োজনীয় ব্যস্ত। ভারতে কংগ্রেসী আমলে অবহেলিত নজরুলকে কমরেড মুজাফফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩), কমল দাশ গুপ্ত ১৯১২-১৯৭৪), আব্দুস সালাম, মজহারুল ইসলাম (নবজাতক প্রকাশনী), কল্পতরু সেনগুপ্ত (১৯৮৬)-সহ একদল নজরুল প্রেমিক মহান নজরুলকে সামনে আনার প্রাথমিক প্রয়াস পান। সে ধারা ষাটের দশকের প্রথম পাদে বিলম্বিত লয়ে শুরু হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বেগবান হয়। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৬ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসায় সেই গতি আরও গতিশীল হয়ে আজো বহমান। নজরুলী যুগের পর থেকে মহা অন্ধকার, তারপর আবার আলোর রেখা দেখা যায়। জগৎ ঘটক (১৯০২-১৯৮৯), নিতাই ঘটক, কমল দাশগুপ্ত, কাজী অনিরুদ্ধ (১৯৩১-১৯৭৪), ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, মনোরঞ্জন সেন, নারায়ন চৌধুরী (১৯১২-১৯৯১) ও কল্পতরু সেনগুপ্ত (১৯১৬-২০০৩), নজরুলী নব জাগরণের প্রধান সৈনিক। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৯৩০-১৯৯২) ও অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় (১৯৩২-১৯৮৩) নব জাগরণের দুই প্রধান সুর শিল্পী। একজন আধুনিক গানের জগৎ ছেড়ে, আর একজন ডাক্তারী পেশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নজরুল সঙ্গীত প্রচার ও প্রসারে আমরণ যুদ্ধ করে গেছেন। নজরুল সঙ্গীতের নব ইতিহাসে এই দুই মহান কণ্ঠশিল্পীর অবদান বাঙালি জাতির জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এক কথায়, তারা নজরুল সঙ্গীতের পুনর্জন্ম দিয়েছেন। বহু গ্রামোফোন পিপাসু মানুষের হৃদয়ে স্পন্দিত হয়েছে। রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডিতে তা ধারণ করে সুর হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিনীর সুর লালিত্য বাংলা গানে কবি সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শিল্পের রূপ, রস ও গন্ধ নজরুল তাঁর রচিত বাণী ও সুরের মাধ্যমে তূরীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যার অনেক গান এখনো অশ্রুত, স্বরলিপিহীন, শ্রুতিবদ্ধহীন, অসুরারোপিত এবং অনাবিষ্কৃত।

ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক যাঁতাকলে পরে নজরুলের অবস্থা ‘ত্রাহি মধুসূদন’। আজ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশে প্রগতিশীলদের ভালবাসায় নজরুল সাহিত্য-সঙ্গীত স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত। বাংলা গানের নব জোয়ারে নজরুল সঙ্গীত এক বিশাল ক্যানভাস জুড়ে রয়েছে। নজরুলের স্বরচিত গ্রন্থ ছাড়া, তাঁর বন্ধুদের স্মৃতিকথায়, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায়, নতুন গবেষণায় এবং আদি সুরের মহিমায় বাংলা গান সর্বপ্লাবী। আজ অভিসন্দর্ভ রচনার সাথে সাথে বেশ কয়েকটি নজরুল বিষয়ক অভিধান প্রকাশিত হওয়ায় বিস্ময় জাগে–এতদিন কেন চাপা পড়েছিল এই সুর ভাণ্ডার। এক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আর প্রগতিশীল রাজনীতিকদের নজরুল চর্চায় অবহেলার কারণে এ ধারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বার বার। কিন্তু বর্তমান চর্চায়, নিম্নলিখিত নজরুল সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থগুলি দেখে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়–’বিশ্ব ব্যাপিয়া আছ তুমি।’

ভাবতে অবাক লাগে যারা নজরুলের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করেনি, নজরুলকে কবি বলতে দ্বিধা করেছে, নজরুল সাহিত্যকে অবমূল্যায়ন করেছেন, নজরুলকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন–তারাই পরবর্তীকালে নজরুলকে সম্বর্ধনা দিয়েছেন; নজরুল তাদের চিনতে পারলে বিদ্রোহ করতেন এবং মেকি সম্বর্ধনায় রাজি হতেন না। এই উপমহাদেশের তথা সাড়া বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের জাতীয় কবিকে যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের জাতীয় কবি অভিধায় অভিষিক্ত করে নিজেরা গৌরবান্বিত হচ্ছেন, তখন শোষিতের বিশ্বকবিকে ছোট করছেন। তাদের অনেকেই নজরুল নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে, কেউ কেউ চেয়ারম্যান, কেউ কেউ নির্বাহী কর্মকর্তা সেজে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। হায়রে বাংলাদেশের নব্য নজরুল প্রেমিক! পৃথিবী তোমাদের ক্ষমা করলেও, অশরীরী নজরুল কিছু করতে না পারলেও প্রকৃত নজরুল গবেষক, শিল্পীরা তোমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না। তোমরা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ট্রাজেডি এই–যারা নজরুল সম্বন্ধে দুটি লাইনও লেখেনি- তাদের কেউ কেউ নজরুলী প্রতিষ্ঠানের কর্তা সেজে বসে। তবে বর্তমানে অনেকেই নজরুলকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়েছেন। নিজের ভাগ্য ফেরাতে নজরুল গবেষক, স্বরলিপিকার সেজেছেন। তাতে এসব অযোগ্য নজরুল গবেষকদের হাতে পড়ে নজরুলচর্চা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন! নিচে নজরুল সঙ্গীত নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থগুলির একটি তালিকা দেওয়া হলো:

বই (প্রথম প্রকাশ)
বুলবুল, (প্রথম প্রকাশ- ১৯২৮) ৪৯টি
চোখের চাতক (প্রথম প্রকাশ- ১৯২৯) ৫৩টি
মহুয়ার গান (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩০) ১৫টি
নজরুল গীতিকা (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩০) ১২৭টি
চন্দ্রবিন্দু (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩১) ৬১টি
সুরসাকী (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩২) ৯৯টি
জুলফিকার (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩২) ২৪টি
বনগীতি (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩২) ৭১টি
গুল-বাগিচা (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৩) ৮৭টি
গীতি শতদল (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪) ১০১টি
গানের মালা (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪) ৯৫টি
নজরুল স্বরলিপি (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩১) ৩৫টি
সুরলিপি (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪) ৩১টি
সুরমুকুর (প্রথম প্রকাশ- ১৯৩৪) ২৮টি

পরবর্তিতে প্রকাশিত গানের সংকলন:

নজরুল সঙ্গীত সম্ভার: নজরুল হস্তলিপি- বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ১৯৮২, গান- ১০৩।
নজরুল গীতি সন্ধানে সংগ্রহ- আব্দুস সাত্তার, শিল্পী কুটির, ১২ ফেব্রুয়ারি- ১৯৭০।
অপ্রকাশিত নজরুল, সম্পাদনা- আব্দুল আজীজ আল আমান, হরফ, (গান- ১৬৩), ১৭/১১/১৯৮৯, কোলকাতা।
জাগো সুন্দর চিরকিশোর, সম্পাদনা- ও সংগ্রহ- আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, আগস্ট ১৯৯১।
অপ্রকাশিত নজরুল-২, সম্পাদনা- ব্রহ্মমোহন ঠাকুর (গান- ৫৬) হরফ প্রকাশনী, ২৫ মে ১৯৯২, কোলকাতা।
নজরুলের হিন্দী গান, সংগ্রহ- আসাদুল হক, জুন ১৯৯৫, গান- ৮১, ঢাকা।
নজরুলের হারানো গানের খাতা, সম্পাদনা- মুহম্মদ নূরুল হুদা, নজরুল ইনস্টিটিউট, (গান- ১৬০), জুন ১৯৯৭।
কার গানের তরী যায় ভেসে, সম্পাদনা- আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, ১.৫.১৯৯৯, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহ, সংগ্রহ ও সম্পাদনা- রশিদুল নবী, নজরুল ইন্সটিটিউট, অক্টোবর-২০০৬, ঢাকা।
পাণ্ডুলিপি (নজরুল সঙ্গীত), সম্পাদনা- আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।

প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণা ও মূল্যায়ন:

নজরুল কাব্যগীতি বৈচিত্র্য ও মূল্যায়ন- ৬, বাঁধন সেনগুপ্ত, (২০/০৭/১৯৭৬), নবজাতক প্রকাশনী।
নজরুল গীতির নানাদিক, শম্ভুনাথ ঘোষ, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রা.লি., মে ১৯৭৭, কলকাতা।
কাজী নজরুলের গান, নারায়ন চৌধুরী, এ মুখার্জী এ- কোম্পানী প্রা. লি., জুন ১৯৭৭, কোলকাতা।
নজরুল সঙ্গীতের সুর বিকৃতি ও সুর সংরক্ষণ- ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, নবজাতক প্রকাশন, মে ১৯৯২।
নজরুলের গানের রাগ, আবুল আজাদ, প্রকাশক- নিজে, নভেম্বর ১৯৯৪, ঢাকা।
নজরুল গীতি আলোচনা, কল্পতরু সেনগুপ্ত, নজরুল একাডেমী, চুরুলিয়া, ১লা নভেম্বর, ১৯৯৫।
সঙ্গীত সংবিৎ, আব্দুশ শাকুর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জুন ১৯৯৭।
ইসলামী ঐতিহ্যে নজরুল সঙ্গীত- আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, জানুয়ারি ২০০০।
নজরুলের রাগভাবনা, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর- নজরুল ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০০০।
রঙ্গমঞ্চে নজরুল, অনুপম হায়াৎ, নজরুল ইনস্টিটিউট, ডিসেম্বর ২০০০।
নজরুলের গান: কবিতার স্বাদ, সফিকুন্নবী সামাদী, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, জানুয়ারি ২০০১।
নজরুল ও মা’ রিফুন্নাসমাত, বাবু রহমান, নজরুল ইনস্টিটিউট, মে ২০০১।
নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপিতে রাগ দর্শন, কৃষ্ণপদ মণ্ডল, নজরুল ইনস্টিটিউট, একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৪।
নব মূল্যায়নে নজরুল গীতি ও স্বরলিপি, সুকুমার মিত্র, পুনশ্চ, ২৬শে মে ২০০৫, কলকাতা।
নজরুল সঙ্গীতের নানা প্রসঙ্গ, বাবু রহমান, গতিধারা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭।
নজরুল সঙ্গীতের বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্য, মায়া রায়, ভাষা; আগরতলা, ত্রিপুরা, মার্চ ২০০৮।

সাক্ষাৎকার ও জীবন:

নজরুল গীতি অন্বেষা, কল্পতরু সেনগুপ্ত, এনবিএ প্রা. লি., জুলাই ১৯৭৭, কোলকাতা।
নজরুল সঙ্গীতের রূপকার, আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, জুলাই ১৯৯০, ঢাকা।
চলচ্চিত্রে নজরুল, আসাদুল হক, বাংলা একাডেমী, মে ১৯৯৩, ঢাকা।
বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, নভেম্বর ১৯৯৫।
বেতারে নজরুল ও তার গান, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, নবজাতক প্রকাশনী, ২৬শে মে ১৯৯৮।
নজরুল যখন বেতারে, আসাদুল হক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৯, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীতের অবিস্মরণীয় শিল্পী, আসাদুল হক, নজরুল একাডেমী, মে ১৯৯৯, ঢাকা।
সুধীজনের দৃষ্টিতে নজরুল সঙ্গীত, আসাদুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউট, মে ১৯৯৯, ঢাকা।
নজরুলের শ্রুতিধর ধীরেন দাস, আসাদুল হক, হাতে খড়ি, জানুয়ারি ২০০৪, ঢাকা।
কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক সাক্ষাৎকার, সম্পাদনা- আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল ইনস্টিটিউট, ২৭ আগস্ট ২০০৪, ঢাকা।

প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ:

সঙ্গীত পরিক্রমা, নারায়ন চৌধুরী, এ মুখার্জী এন্ড কো. প্রা. লি., ১৯৫৫।
বাংলা গানের গতিপথ, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, ডি.এম. লাইব্রেরি, ১৯৫৫, কলকাতা।
আমার জীবনের কথা, আব্বাস উদ্দীন, হরফ প্রকাশনী, মাশহুদা বেগম, ২৪ পরগণা।
সবারে আমি নমি, কাননবালা (অনুলিখন-সন্ধ্যা সেন), এম.সি. সরকার এ- সন্স প্রা.লি., ১৯৭৩।
বাংলার বুলবুল আঙ্গুরবালা, প্রশান্ত দাঁ, ভারতী বুক স্টল, জুন-১৯৮৩, কলকাতা।
স্মরণ-বরণ, গোপাল দাস মজুমদার, ডি.এম. লাইব্রেরি, ১৮ জুন, ১৯৮১, কলকাতা।
ইন্দুবালা, ড. বাধন সেন গুপ্ত, মৌসুমী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, কলকাতা।
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, শ্রী জগন্ময় মিত্র, ইন্ডিয়ান এসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রা. লি., ৭/২/৮৫।
আমার সঙ্গীত জীবন ও আনুষঙ্গিক জীবন, সন্তোষ সেন গুপ্ত, এ মুখার্জী এন্ড কোম্পানী প্রা. লি., বইমেলা, ১৯৮৬।
সুরের আগুন, গোলাম কুদ্দুস, দীপায়ন, ১৯৮৭, কলকাতা।
তুলসী লাহিড়ী, বিজিত কুমার দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমী, জুন ২০০৫, কলকাতা।
অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ, কল্যাণী কাজী, সাহিত্যম, মে ১৯৯৮, কলকাতা।
কাজীদার সঙ্গে (জগৎ ঘটক ও নিতাই ঘটক), সম্পাদনা- কল্পতরু সেনগুপ্ত, নজরুল একাডেমী, চুরুলিয়া, এপ্রিল ১৯৯৭, ভারত।
বিস্মৃত সুরশিল্পী কে মল্লিক, সংগ্রহ, সম্পাদনা, ভূমিকা: আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, অক্টোবর ২০০১।
ফৈয়াজী আলোকে নজরুল গীতি- কাকলী সেন, আদি নাথ ব্রাদার্স, বৈশাখ ১৪১৫ (২০০৮)।
বিমানে বিমানে আলোকের গানে, সিতাংশু শেখর ঘোষ, যোগমায়া প্রকাশনী, জানুয়ারি ২০০৩।
দুখু মিয়ার লেটো গান, মুহাম্মদ আয়ুব হোসেন, নজরুল ফাউন্ডেশন, বিশ্বকোষ পরিষদ, ৬ ডিসেম্বর ২০০৩, কোলকাতা।

অভিধানসমূহ:

নজরুল সঙ্গীত কোষ (আংশিক), সুরবাণী পত্রিকা, বাবু রহমান, ১৯৮৪, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীত অভিধান, আঃ সাহাব, নজরুল ইনস্টিটিউট, প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার, ২৫ মে ১৯৯৩।
নজরুল শব্দকোষ, আবুল কালাম মুস্তাফা, বাংলা একাডেমী, মে ১৯৯৩, প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী।
নজরুল গীতি সহায়িকা, কল্পতরু সেনগুপ্ত, প.রাজ্য.স.এ, জুন ১৯৯৭
নজরুল শব্দপঞ্জি, হাকিম আরিফ, নজরুল ইন্সটিটিউট, জুন ১৯৯৭, ঢাকা।
নজরুল সঙ্গীত কোষ, ব্রহ্মমোহন, বাণী প্রকাশ, জানুয়ারি ১৯৯৪।
নজরুল সঙ্গীত কোষ, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, নজরুল ইনস্টিটিউট, মে ২০০৯।
চাঁদেরে ঘিরি নাচে ধিরি ধিরি তারা অগণন, বাবু রহমান।

লেটো দলের ব্যাঙাচি থেকে বিদ্রোহী কবিঃ মোঃ মিন্টু হোসেন

ছোট্ট এক গ্রাম চুরুলিয়া। সেই গ্রামে একরাতে উৎসবের রোল উঠলো। সে এক দারুণ কাণ্ড। আশপাশের দশ গ্রামের লোক জমেছে সেখানে। তারা ‘লেটো’ গান শুনবে। গান দিয়ে দুই দলের লড়াই হবে, মজা করে সেই লড়াই দেখবে।যথাসময়ে লেটো গানের আসর শুরু হলো। দু’দলের লড়াই বেশ জমে উঠেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। একদল গান করে আরেকদলের জন্য প্রশ্ন রেখে যায়। আরেক দল গানের মধ্যেই যুক্তি-তক্কো দিয়ে তার উত্তর দেয়, আবার পাল্টা প্রশ্ন রেখে যায়। লড়াই ভারি জমে উঠেছে। ভিন গায়ের এক নামকরা দল আজ এসেছে আসরে। এই দলের খুবই নাম ডাক। আসর শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কোণঠাসা করে ফেললো বিপক্ষ দলকে।

বিপক্ষ দলের এই হেরে যায় যায় ভাব, এমন সময় সেই দলের এক ফুটফুটে চেহারার ছেলে উঠে এলো মঞ্চে। মঞ্চ সাজানো হয়েছিলো রকমারি বাতি দিয়ে। আলো পড়ে ছেলেটির মুখ আর চোখ যেনো ঝলকে উঠছিলো। তার চুলগুলো এ সময় বেশ লম্বা ছিলো। ছেলেটি মঞ্চে উঠে হাত পা নেড়ে, নাচের তালে তালে গাইতে লাগলো। যেমন তার মিষ্টি গলা তেমন তার অভিনয়। দেখেশুনে মুগ্ধ হয়ে গেলো আসরের সবাই। প্রায় হেরে যাওয়া দলে জাগলো খুশির জোয়ার।

এ সময় অবশ্য ছেলেদের মেয়ে সেজেই গান গাইতে হতো। তবে, এই কিশোরের লম্বা চুলে তো তাকে এমনিতেই মেয়ে বলে চালিয়ে দিয়েছিলো লেটোর দলের ওস্তাদজী।

ভিনগায়ের দল গানের ভেতর দিয়ে নানা রকম সওয়াল করছিলো। সওয়াল মানে প্রশ্ন। আর বালক কবি নাচতে নাচতে, কোমর দুলিয়ে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে দুহাত ওপরে তুলে সুর করে তাদের সব সওয়ালের উত্তর দিয়ে দিলো। তারপর করে বসলো এক জবর প্রশ্ন।

ব্যস! আর যায় কোথায়? ভিন গাঁয়ের দল পড়লো মহা মুশকিলে। তারা কোনো জবাবই খুঁজে পেলো না। সবাই বসে রইলো মাথা নীচু করে। জয়ী হলো বালকের দল।



নিমশা গ্রামে রাখাল বালক আর নিষ্কর্মা ছেলেরা একটা গানের দল গড়ে তুলেছিলো। তবে, শখ করে তৈরি এই দলটিতে তেমন কোনো গায়ক ছিলো না যে নেচে গেয়ে তালে তালে পালাগান করতে পারবে। কিন্তু ছোটো এই বালকটিকে পেয়ে তো তারা ধন্য হয়ে গেলো।



পালা শেষ হলো। আসরের মধ্যেই বালক-কবিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন দলের সরদার। বললেন-‘ওরে আমার ব্যাঙাচি, বড় হয়ে তুই একদিন নিশ্চয়ই গোখরো সাপ হবি।’



তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূভাষায় তার দখল ছিল। এই ছেলেটি ওস্তাদ বজলে করিমের প্রভাবেই লেটো দলে যোগ দিয়েছিলো। এছাড়াও ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় আরেক ওস্তাদ ছিলেন লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়াল বাসুদেব। এই দলের সঙ্গেই তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। লেটোর দলের অধিকাংশ শিল্পীরা ছিল মূলত কিশোর। লেটো গানের দলে কিশোরদের অংশগ্রহণ থাকতে হতো আর যে সব কিশোর লেটোর গানে অংশ নিতো তারা ব্যাঙাচি’ নামে পরিচিত হতো।



লেটো গানে কিশোররা মেয়ে সেজে নাচ করে। তাদের বলা হয় বাই, ছোকরা ও রাঢ়। রাজকন্যা বা রাণী সাজে যারা তাদের বলা হয় রাণী। পাঠক বলা হয় যারা রাজা, মন্ত্রী, রাজপুত্র ও সেনাপতি সাজে। আর যারা নাচ, গান, অভিনয় ও সংলাপ ইত্যাদির দ্বারা দর্শক-শ্রোতাদের হাসায় তাদের বলা হয় সংদার বা সঁংগাল। গানের আসরে বিপক্ষের গোদা কবিকে হারিয়ে দিতেন, তা দেখে তাঁর চাচা লেটো গুরু বজলে করীম বলতেন, দুখু ‘বেঙাচি নয় গোখরো’, তিনি লেটো গানের জন্যে উপাধি পান ‘ভ্রমর কবি বা ভোমর কবি’ হিসেবে।



একসময় সুযোগ বুঝে গ্রামের ‘লেটো’ দলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এতে তার নাম হয়েছিলো। তাছাড়া, সমাজের নানা ধরনের লোকের সঙ্গে মেশবার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। এটা-ওটা জানবার সুযোগও প্রচুর পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু ছন্নছাড়া জীবন তাঁকে হাতছানি দিতে লাগলো-বড় কিছু করার জন্য।



এই লেটো দলে থাকার সময়ই তার কবিতা রচনায় হাতে খড়ি হয়েছিলো। তখন তার বয়স আর কতোই বা হবে, এই তোমাদেরই মতোই। হয়তো বারো কি তেরো, সেই বয়সেই তিনি এমন সব কবিতা রচনা করতেন যে, সকলের তাক লেগে যেতো। তার সে সময়কার একটি কবিতা শোনো-
চাষ করো দেহ জমিতে।

হবে নানা ফসল এতে।।
নামাজে জমি ‘উগালে’
রোজাতে জমি‘সামলে’
কলেমায় জমিতে মই দিলে
চিন্তা কি হে এই ভবেতে।।

চুরুলিয়া, নিমশা আর রাখাকুল-এই তিন গ্রামে তখন ছিলো তিনটি নামকরা লেটো দল। এসব দলের জন্য নাটক রচনার ভার পড়লো বালক নজরুলের ওপর। এতে তিনি দুটো পয়সার মুখ দেখলেন বটে, কিন্তু বাড়ির লোকেরা তার এসব গান-বাজনা করাটা মোটেই পছন্দ করলো না। কারণ তাদের কাছে এগুলো হলো বে-শরীয়তি কাজ।এর ওপর তার দুরন্তপনা তো আছে। গ্রামের লোকজনও শেষে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো।



নজরুলের নিজেরও আর কিছু ভালো লাগছিলো না। লেটো নিয়ে যতোই মেতে থাকুন, মনটা ছিলো তার উড়ু উড়ু। গাঁয়ের লোকের গঞ্জনা আর বাড়ির লোকের ‘ব্যাজার’ মুখ সেই মনকে করে দিলো একেবারে বিদ্রোহী। আর তার পরপরই বিদ্রোহী ছেলেটিই গ্রাম ছাড়লেন। গ্রাম ছেড়ে তিনি গেলেন আসানসোলের এক কয়লার খনিতে চাকরি করতে। চাকরি অবশ্য তার জুটলো না। শেষমেষ চাকরি জুটলো এক রুটির দোকানে। সেখানে খুব ভোরে উঠে তাকে রুটির জন্য আটা মাখাতে হতো। আর তারপর সারাদিন দোকানে বসে রুটি বিক্রি করতে হতো। মাইনে ছিলো মাসে মাত্র এক টাকা। তাতেই তিনি খুশি। কিন্তু তিনি নানান কথা ভাবতে থাকেন দোকানে বসেই। দোকানে বসেই আটা মাখতে মাখতে গা বেয়ে তার ঘাম ঝরতে থাকে। তিনি পেরেশান হয়ে পড়েন। এসময় তার মনটাতে চাংগা করে তুলতে নিজেই গান বেঁধে গাইতে থাকেন-

মাখতে মাখতে গমের আটা
ঘামে ভিজলো আমার গাটা।

তার এই গান শুনে সংগী-সাথীরা তো হেসেই খুন। নজরুল তখন গম্ভীর হয়ে বলতেন, ‘তোমরা আমাকে ঠাট্টা করছো! কিন্তু দেখো, যেমন করেই হোক, একদিন আমি এ দেশের মস্ত বড়ো কবি হবো।’

মনের জোর আর নিজের সাধনার জোরেই, নিজের বিদ্রোহী স্বপ্ন দেখার ফলেই লেটোর এই ব্যাঙাচি পরে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তো আর রুটির দোকানের সেই গায়কটি নন, বড়ো হয়ে তিনি হয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি। তিনিই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/এমএইচ/এইচআর/মে ২৫/১১

আজ দুখু মিয়ার ১১২তম জন্মবার্ষিকী

আজ ১১ই জ্যৈষ্ঠ অবহেলিত,উপেক্ষিত,আমাদের চির দুঃখী দুখু মিয়ার ১১২তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে বাঙালির এই প্রিয়কবির জন্ম। অসাম্য, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অক্লান্ত বিদ্রোহী,চির উন্নত শির। বিদ্রোহে, প্রেমে, মানবিকতায় শ্রেষ্ঠতম পুরুষ নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতির এক উজ্জ্বল প্রেরণা। 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়'হয়ে এসেছিলেন এই চির বিদ্রোহী-প্রেমিক কবি। বাংলা কাব্যে এক নতুন যুগের স্রষ্টা নজরুল পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে মুক্তির বাণী বয়ে এনেছিলেন তার কাব্যে। সূচনা করেছিলেন এক নতুন যুগের। 'অগ্নিবীণা', 'বিষের বাঁশী' আর 'ভাঙ্গার গান' গেয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি গোটা উপমহাদেশের মানুষকে। উল্কার মতো এসে আবার উল্কার মতো মিলিয়ে গেলেন বাকশক্তি হারিয়ে। দীর্ঘায়ু পেলেও তার সাহিত্যজীবন মাত্র ২৩ বছরের। এ স্বল্প পরিসর জীবনে নজরুলের বিপুল সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ঘটনাবহুল কর্মময় যেমন তার জীবন,তেমনি বিচিত্র তার সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে উপমহাদেশের মুক্তির আন্দোলন এবং একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের কবিতা ও গান ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। বাংলা গানের জগতে নজরুল সুর ও বাণীর ক্ষেত্রে ঘটিয়েছেন এক অনন্য বিপ্লব। এক অতুলনীয় ঐশ্বর্যে তিনি ঋদ্ধ করেছেন বাংলা গান। এখনও বাঙালি জীবনে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেতার বিচিত্র রচনা। তাই তো তিনি বাঙালি তথা বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য তাকে শত কোটি শ্রদ্ধা জানাই।

আমাদের জাতীয় কবি,বিদ্রোহী কবি,সাম্যের কবি হওয়ার পরেও কেন জানি খুবই খারাফ লাগছে ভাবতে যে, আজও তার প্রতিভার যথার্থ মুল্যায়ন অর্জন করতে পারেনি। কবিকে তার মর্যাদার আসনে বসাতে আজ আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
বছর ঘুরে আবার যখন এই দিনটি এলো। মিডিয়াতে, শ-খানেক ব্লগে, টুইটারে, ফেসবুকে ব্যতিক্রম কিছু দেখব আশা করেছিলাম। কিন্তু সে আশা হতাশায় রূপ নিল যখন দেখলাম কোথাও ফলাও করে চাপা হয়নি দুখু মিয়ার জন্মবার্ষিকী। লেখা হয়নি তাকে নিয়ে কোন বড় বড় ব্লগ পোস্ট। কেউ যেন মনে রেখেও মনে রাখেনি। দুই-এক জায়গায় হালকা আপডেট আর কিছু পোস্ট দেখলাম। ব্যস! আফসোস!

সব শেষে এক ব্লগারের এক লাইনের উক্তি দিয়ে শেষ করছিঃ "সবই এবং সবাই আছে, নেই শুধু চির দুখি আমাদের দুখু মিয়া"- অন্য হাওয়া

Tuesday 24 May 2011

গানের আড়াল

তোমার কন্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কন্ঠের গান-
এইটুকু শুধু র'বে পরিচয়? আর সব অবসান?
অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়,
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?

হয়ত কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়ত কহিনি কথা,
গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা?
হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার , তাহারি প্রতিধ্বনি
কন্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণরণি'-
উপকূলে ব'সে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে?
বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দুল হ'য়ে শুধু কানে?

Wednesday 18 May 2011

মুসলিম আমার নাম

চীন আরব হিন্দুস্থান, নিখিল ধরাধাম
জানে আমায়, চেনে আমার, মুসলিম আমার নাম।।

অন্ধকারে আজান দিয়ে ভাংলো ঘুমঘোর,
আলোর অধিক চাঁদ এনেছি, রাত করেছি ভোর,
এক সমান করেছি ভেঙ্গে উচ্চ- নীচ তামাম।।

চেনে মোরে সাহারা গোবি দুর্গম পর্বত,
মন্থন করেছি সাগর নহর সিন্ধু হ্রদ,
বয়েছি আফ্রিকা ইউরোপে আমারই তাঞ্জাম।।

পাক মুলুকে বসিয়েছি সোনার মসজিদ,
জগৎ শত্রু পাপীদেরকে পিইয়েছি তৌহিদ;
বিরান - বনে রচেছি যে হাজার নগর গ্রাম।।

-কাজী নজরুল ইসলাম-

Tuesday 17 May 2011

এল শোকের মোহররম

(মর্সিয়া)
এল শোকের সেই মোহররম কারবালার স্মৃতি লয়ে।
আজি বে-তাব বিশ্বমুসলিম সেই শোকে রোয়ে রোয়ে।।

মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুশের বাচ্চায়
পানি চাহিয়া পেল শাহাদাত হোসেনের বক্ষে রয়ে।।

এক হাতে বিবাহের কাঙ্গন এক হাতে কাসেমের লাশ,
বেহুঁশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা সয়ে।।

ঝরিছে আঁখিতে খুন হায় জয়নাল বেহুঁশ কেঁদে
মানুষ ব'লে সহে এত পাথরও যেত ক্ষয়ে।।

শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হযরত হোসেন শহীদ,
আসমানে শোকের বারেষ, মরে আজি খুন হয়ে।।

(গুল বাগিচা) - কাজী নজরুল ইসলাম-