যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -

Monday 21 May 2012

নজরুলের শেষ জীবনের সাক্ষী কবি ভবন

নজরুলের শেষ জীবনের সাক্ষী কবি ভবন: হাসান শান্তনু
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/05/21/146038




ঢাকার ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০ নম্বরের বাড়িটা ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাসভবন। কবির শেষ জীবনের সাক্ষী এ কবি ভবনে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল ইনস্টিটিউট। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেন। নজরুলের স্মৃতিরক্ষা, তার জীবন, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, রচনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশনা ও প্রচার আর দেশ-বিদেশে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার জন্য প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। কবি ভবনের যে ঘরে কবি ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত ৩ বছর ১ মাস ২৮ দিন ছিলেন, সেই ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল জাদুঘর। এতে সংরক্ষিত আছে কবির হস্তলিপির ফটোকপি, কবিতার বইয়ের দুর্লভ সংস্করণের ফটোকপি, দুর্লভ আলোকচিত্র, আদি গ্রামোফোন রেকর্ড, আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের অডিও ক্যাসেট আর অন্যান্য নজরুল স্মৃতিচিহ্ন। আছে নজরুল চিত্রকলা গ্যালারি, যা নজরুল বিষয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা। এসব চিত্রকর্ম দেশের প্রতিথযশা শিল্পীদের নজরুলের জীবন, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে আঁকা। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত নজরুল স্মৃতিচিহ্ন দেখতে জাদুঘরে আসেন নানা বয়সের নজরুলপ্রেমী।
তবে সরকারের চরম অবহেলার শিকার নজরুল ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি এখন পড়েছে মহাজোট সরকারের রোষানলে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের উদ্যোগ, পরিকল্পনা, প্রকল্প নেয়ায় সরকারের এ রোষানলের শিকার হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিবেচনায় জাতীয় কবির প্রতি উপেক্ষা, অবহেলাও এর কারণ বলে দায়ী করছেন নজরুল গবেষক, বিশেষজ্ঞরা। এ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বন্ধ হতে থাকে ইনস্টিটিউটের নানা কার্যক্রম। ফলে থেমে আছে নজরুল গবেষণা। নজরুলের বই আরবিসহ বিদেশি ভাষায় অনুবাদ, তার স্মৃতিজড়িত জায়গাগুলো ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র, তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ ও পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার কাজ প্রায় বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যাপ্ত লোকবল ও বাজেট নেই। জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। নজরুল জাদুঘরকে আজও সমৃদ্ধ করতে পারেননি ইনস্টিটিউট কর্মকর্তারা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নজরুল ইনস্টিটিউট নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি সীমিত সাধ্য দিয়েও নজরুল বিষয়ে গবেষণা করছে। প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী বই, নজরুলের দুর্লভ সঙ্গীতের সিডি, তথ্যচিত্র, পত্রিকা, স্মরণিকা, বুলেটিন, বর্ষপঞ্জি, পোস্টার ও উপহার সামগ্রী। সংগ্রহ করেছে নজরুল বিষয়ক দুর্লভ উপকরণ, তথ্য ও উপাত্ত। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত ‘নজরুল অ্যালবামে’ আছে কবির কৈশোরকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রামশীল, বর্ণাঢ্য ও সুখ-দুঃখময় দীর্ঘ জীবনের রঙিন, সাদা-কালো আলোকচিত্র। ইনস্টিটিউট প্রকাশ করেছে ‘নজরুল সঙ্গীত অভিধান’, ৩০টি খণ্ডে ৭৫০টি শুদ্ধ নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, নজরুলসঙ্গীতের সঙ্কলন ‘নজরুলসঙ্গীত সমগ্র’, পাকিস্তান থেকে সংগৃহীত নজরুলের হস্তলিপির পাণ্ডুলিপি ‘নজরুলের হারানো গানের খাতা’সহ আদি গ্রামোফান রেকর্ড থেকে ধারণকৃত নির্বাচিত নজরুলসঙ্গীতের অডিও সিডি। প্রতিষ্ঠানটি নজরুলের কবিতা, গানসহ অন্যান্য রচনা বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করছে। এ পর্যন্ত ইংরেজি, ফরাসি, উর্দু, ইতালি, তুর্কি ও চীনা ভাষায় নজরুলের কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনা অনূদিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘ইন দ্য আইজ অব কাজী নজরুল ইসলাম : কামাল পাশা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায়। ‘৮৬ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর নজরুল স্মৃতিপদক, নজরুল পদক দিচ্ছে। নজরুল সাহিত্য ও কর্মকাণ্ড সবস্তরে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটি নজরুলসঙ্গীত প্রশিক্ষণ কোর্স ও আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছে।
তবে নজরুল চর্চাবিষয়ক একমাত্র সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের বাজেটের বড় অংশ গবেষণার বদলে খরচ হচ্ছে এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, গাড়ির তেল ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তদের নেই নজরুল বিষয়ে গবেষণা। সরকারের অবহেলায় সেখানে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম বিরাজ করছে। গবেষণার বদলে বছরে নজরুল বিষয়ক ১২টি অনুষ্ঠান আয়োজনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটির মূল কর্মকাণ্ড। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নজরুলের স্মৃতিজড়িত স্থান, স্থাপনা দেখার সুযোগ করে দিতে ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ‘নজরুল পর্যটন’ চালুর উদ্যোগ নেয় ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এ প্রকল্প গত জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বন্ধ। নজরুল বিষয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৫ সালে ইনস্টিটিউটের চালু করা ‘বৃত্তি’ও বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটির ‘উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ (সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় সর্বশেষ বৃত্তি দেয়া হয় ২০০৬ সালে। নজরুলের স্মৃতিজড়িত স্থানগুলোর তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগও নেয়া হয় ওই বছর। ‘কুমিল্লায় নজরুল’, ‘ত্রিশালে নজরুল’, ‘চট্টগ্রামে নজরুল’ শিরোনামে ওই বছর ৩টি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। অন্য জায়গাগুলোর ওপর তথ্যচিত্র এখন নির্মাণ হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির পত্রিকা ‘ত্রৈমাসিক নজরুল ইনস্টিটিউট’ ও ইংরেজি ‘জার্নাল’ নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে না। ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত পুরনো বেশিরভাগ বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না। পুনর্মুদ্রণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। ইনস্টিটিউট ভবনের নিচতলার বিক্রয়কেন্দ্র, এমনকি এর লাইব্রেরিতেও অনেক বই নেই। নজরুলের স্বরলিপিও লাইব্রেরিতে খুঁজে পাচ্ছেন না পাঠক, গবেষকরা। কী কী কার্যক্রম এখন চলছে, এগুলোর সাম্প্রতিক তালিকা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের কাছে নেই। যেসব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, সেগুলো চালু করার উদ্যোগ নিতেও সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা আবেদন করছেন না। প্রতিষ্ঠানটির সাড়ে তিন শতাধিক প্রকাশিত বই থাকলেও বিক্রয়কেন্দ্র মাত্র একটি।

No comments:

Post a Comment