http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/05/20/145916
ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নানা স্মৃতিজড়িত স্থান। কোথাও বসে কবি লিখেছিলেন কালজয়ী গান, কোথাও লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা। কোথাও বসে তিনি গেয়েছিলেন নিজ কণ্ঠে গান। কোথাও কবি দিয়েছিলেন নির্বাচনী বক্তৃতা। আবার কোথাও কবিকে ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষীরা জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত সংবর্ধনা। কবির স্মৃতিজড়িত স্থানের মধ্যে কোমল ঘাসের পার্ক থেকে শুরু করে আছে স্থাপত্যশৈলী, ঐতিহ্যঘেরা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর। রাষ্ট্রের চরম অবহেলায় এসব স্থান নিশ্চিহ্ন হতে বসলেও অনেক স্থান এখনও টিকে আছে কবির প্রতি মানুষের প্রবল ভালোবাসার টানে। সরকার, রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এসব স্থান রক্ষায় এগিয়ে না এলেও কবির প্রতি শ্রদ্ধা থেকে মানুষ অনেক স্থানে লাগিয়েছেন স্মৃতিফলক। গবেষকদের দেয়া তথ্যমতে, ঢাকার নানা এলাকা মিলিয়ে নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থান আছে ৩১টি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে জাতীয় কবির স্মৃতিময় এসব স্থান রক্ষায় সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। সংরক্ষণের অভাবে বদলে যাচ্ছে অনেক স্থান। সরেজমিনে অধিকাংশ স্থানে স্মৃতিফলক পর্যন্ত চোখে পড়েনি। এসব স্থানে স্মৃতিফলক লাগাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কাছে নজরুল ইনস্টিটিউট ২০০৬ সালে আবেদন করে। এ আবেদনে ডিসিসি আজও সাড়া দেয়নি।
ঢাকার যে কোনো দিক থেকে ঘুরলে নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থান দেখা যায়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের বাড়িতে আছে কবি ভবন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ’৭৫-এর ২২ জুলাই পর্যন্ত কবি এ বাড়িতে ছিলেন। পরিকল্পনার অভাবে এ বাড়ি লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে গেছে। বাড়িটির সামনে যে বাগানে কবি হাঁটতেন, ঘুরতেন—সেখানে এখন গাড়ির গ্যারেজ। সেই বাগান আর নেই। তবে বাড়িটিতে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুলচর্চা বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। এর প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহর দেয়া তথ্যমতে, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেন। নজরুলের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখা, তার জীবন, সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার জন্য তিনি কবি ভবন নামে প্রকল্পটি নেন। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর প্রকল্পটি তিন-চার বছর বন্ধ ছিল। এরশাদ সরকার প্রকল্পটির নাম বদলে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প নামে অনুমোদন দেয়। ওই সরকারের খেয়াল-খুশিমতই সেটি বাস্তবায়িত হয়।’
পুরনো ঢাকার ৫২ বেচারাম দেউড়ির মৌলভি আবদুল হাসনাত সাহেবের বাড়িতে বসে নজরুল একবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। বাড়িটির সামনের বাগানে বসে কবি লেখেন তার বিখ্যাত গান ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘দোলনচাঁপার হিন্দোলে’ বইয়ে উল্লেখ আছে—‘বেচারাম দেউড়িতে নজরুলের ভক্ত ছিলেন পীর সৈয়দ মোহাম্মদ ইউসুফ। তার জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে কবি ঢাকার ওই বাড়িতে ছিলেন।’
জানা যায়, নজরুল ঢাকায় এলে এ বাড়িতে থাকতেন। তবে যে ঘরে তিনি থাকতেন সেটি এখন তালাবদ্ধ। টিন দিয়ে ছাওয়া ওই ঘর এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গুদামঘর হিসেবে। আর বাড়ির সামনের বাগানটি এখন ইট-বালি-সিমেন্টের ভাগাড়। এলাকার অনেক বাসিন্দা জানেন না বাড়িটির ইতিহাস। বাড়ির দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়েছে বটগাছ। এলাকাবাসী নজরুলের স্মৃতি ধরে রাখতে দেয়ালে লিখেছে তার সেই গানটি—‘বাগিচায় বুলবুলি তুই...’। সেখানকার অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, সরকার বা নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে কবির এ স্মৃতিস্থান রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
নজরুল গবেষক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল হাই শিকদার জানান, ‘সদরঘাটের পূর্ব-উত্তর কর্নারে একসময় ছিল করোনেশন পার্ক। পার্কের জায়গায় এখন মার্কেট। পার্কের সেই মঞ্চ এখনও আছে—যে মঞ্চে বসে কবি গেয়েছেন অনেক গান।’ তবে এ মঞ্চও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বদলে যাচ্ছে। রমনা পার্কের বটতলায় বসে কবি ‘নিশি ভোর হলো’ গানটি লিখেছিলেন বলে জানান আবদুল হাই শিকদার। ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলেও আছে কবির স্মৃতি। ঢাকার নবাব পরিবারের এ বিখ্যাত ভবনে একবার কবিকে দেয়া হয়েছিল সংবর্ধনা। নবাব পরিবারের মেয়ে মেহের বানুর আঁকা ছবি দেখে কবি লিখেছিলেন ‘খেয়াপারের তরুণী’র মতো কলোত্তীর্ণ কবিতা। বনগ্রাম লেনের রানু সামের বাড়িটিও নজরুলের স্মৃতিধন্য। এ বাড়িতে তিনি তার এক ছাত্রীকে গান শেখাতেন। শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে একদিন অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র ছিল। কবি এখানে এসে গান গেয়েছিলেন।
তথ্যমতে, বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসে আছে নজরুলের অনেক দিনের স্মৃতি। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে তিনি প্রায় আড়াই সপ্তাহ ছিলেন। তখন প্রথমদিকে আবুল হোসেনের বাসায় উঠলেও পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবির বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাসা বর্ধমান হাউসে (১৯৫৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমী) ওঠেন। ক’মাস পর হঠাত্ করে বন্ধুদের সঙ্গে আবার আসেন। বর্ধমান হাউসে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ভবনের সামনের বটগাছের নিচে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল মঞ্চ। ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ ও ‘নজরুল মঞ্চ’ অব্যবস্থাপনা আর অযত্নের শিকার। স্মৃতিকক্ষ প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত দর্শকের জন্য খোলা থাকার কথা। অথচ সেটিও তালাবদ্ধ থাকে সব সময়। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে প্রতিষ্ঠিত ‘নজরুল কর্নার’-এরও একই অবস্থা। এখানে আছে কবির ব্যবহৃত অনেক জিনিস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির মাজার অবস্থিত। সুপারি গাছে ঘেরা ছোট্ট প্রাঙ্গণটি চিরতরের জন্য আপন করে নিয়েছেন তিনি। সেখানে ভেসে বেড়ায় আজানের সুর। কবরস্থানটি এখন বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। মাজার সংলগ্ন এলাকাটির সৌন্দর্য বাড়াতে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হয়। কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট এর উদ্বোধন হয়। ১৯৯৮ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠকে ওই কমপ্লেক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে আজও সেটি সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেও এখন পর্যন্ত সেটি কেন খোলা হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর অনেকের অজানা। কমপ্লেক্সে নজরুলের স্মৃতিস্মারক বিষয়ক তথ্যকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা থাকলেও আজও তা হয়নি। ঢাকার ফার্মগেটের পার্কটি থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম বের করেছিলেন ‘নজরুল র্যালি’। সেখানেও নেই এ বিষয়ক কোনো স্মৃতিফলক।
উল্লেখ্য, নজরুল প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন ১৯২৬ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে। তখন তিনি উঠেছিলেন পুরনো ঢাকার মোহিনী মোহন দাসের বাড়িতে। ওই বছরের অক্টোবরে তিনি আবার আসেন ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদস্য পদপ্রার্থী হয়ে ভোট চাইতে। সুস্থাবস্থায় নজরুল শেষবার ঢাকা এসেছিলেন ১৯৪০ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠানে। ১৯২৬ থেকে ’৪০ সালের মধ্যে নজরুল অনেকবার ঢাকায় এসেছেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ঢাকায় আসার সময় কবি ছিলেন অসুস্থ। ঢাকাতেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্টে কবির মৃত্যু হয়।
No comments:
Post a Comment