যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -

Wednesday 25 May 2011

লেটো দলের ব্যাঙাচি থেকে বিদ্রোহী কবিঃ মোঃ মিন্টু হোসেন

ছোট্ট এক গ্রাম চুরুলিয়া। সেই গ্রামে একরাতে উৎসবের রোল উঠলো। সে এক দারুণ কাণ্ড। আশপাশের দশ গ্রামের লোক জমেছে সেখানে। তারা ‘লেটো’ গান শুনবে। গান দিয়ে দুই দলের লড়াই হবে, মজা করে সেই লড়াই দেখবে।যথাসময়ে লেটো গানের আসর শুরু হলো। দু’দলের লড়াই বেশ জমে উঠেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। একদল গান করে আরেকদলের জন্য প্রশ্ন রেখে যায়। আরেক দল গানের মধ্যেই যুক্তি-তক্কো দিয়ে তার উত্তর দেয়, আবার পাল্টা প্রশ্ন রেখে যায়। লড়াই ভারি জমে উঠেছে। ভিন গায়ের এক নামকরা দল আজ এসেছে আসরে। এই দলের খুবই নাম ডাক। আসর শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কোণঠাসা করে ফেললো বিপক্ষ দলকে।

বিপক্ষ দলের এই হেরে যায় যায় ভাব, এমন সময় সেই দলের এক ফুটফুটে চেহারার ছেলে উঠে এলো মঞ্চে। মঞ্চ সাজানো হয়েছিলো রকমারি বাতি দিয়ে। আলো পড়ে ছেলেটির মুখ আর চোখ যেনো ঝলকে উঠছিলো। তার চুলগুলো এ সময় বেশ লম্বা ছিলো। ছেলেটি মঞ্চে উঠে হাত পা নেড়ে, নাচের তালে তালে গাইতে লাগলো। যেমন তার মিষ্টি গলা তেমন তার অভিনয়। দেখেশুনে মুগ্ধ হয়ে গেলো আসরের সবাই। প্রায় হেরে যাওয়া দলে জাগলো খুশির জোয়ার।

এ সময় অবশ্য ছেলেদের মেয়ে সেজেই গান গাইতে হতো। তবে, এই কিশোরের লম্বা চুলে তো তাকে এমনিতেই মেয়ে বলে চালিয়ে দিয়েছিলো লেটোর দলের ওস্তাদজী।

ভিনগায়ের দল গানের ভেতর দিয়ে নানা রকম সওয়াল করছিলো। সওয়াল মানে প্রশ্ন। আর বালক কবি নাচতে নাচতে, কোমর দুলিয়ে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে দুহাত ওপরে তুলে সুর করে তাদের সব সওয়ালের উত্তর দিয়ে দিলো। তারপর করে বসলো এক জবর প্রশ্ন।

ব্যস! আর যায় কোথায়? ভিন গাঁয়ের দল পড়লো মহা মুশকিলে। তারা কোনো জবাবই খুঁজে পেলো না। সবাই বসে রইলো মাথা নীচু করে। জয়ী হলো বালকের দল।



নিমশা গ্রামে রাখাল বালক আর নিষ্কর্মা ছেলেরা একটা গানের দল গড়ে তুলেছিলো। তবে, শখ করে তৈরি এই দলটিতে তেমন কোনো গায়ক ছিলো না যে নেচে গেয়ে তালে তালে পালাগান করতে পারবে। কিন্তু ছোটো এই বালকটিকে পেয়ে তো তারা ধন্য হয়ে গেলো।



পালা শেষ হলো। আসরের মধ্যেই বালক-কবিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন দলের সরদার। বললেন-‘ওরে আমার ব্যাঙাচি, বড় হয়ে তুই একদিন নিশ্চয়ই গোখরো সাপ হবি।’



তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূভাষায় তার দখল ছিল। এই ছেলেটি ওস্তাদ বজলে করিমের প্রভাবেই লেটো দলে যোগ দিয়েছিলো। এছাড়াও ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় আরেক ওস্তাদ ছিলেন লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়াল বাসুদেব। এই দলের সঙ্গেই তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। লেটোর দলের অধিকাংশ শিল্পীরা ছিল মূলত কিশোর। লেটো গানের দলে কিশোরদের অংশগ্রহণ থাকতে হতো আর যে সব কিশোর লেটোর গানে অংশ নিতো তারা ব্যাঙাচি’ নামে পরিচিত হতো।



লেটো গানে কিশোররা মেয়ে সেজে নাচ করে। তাদের বলা হয় বাই, ছোকরা ও রাঢ়। রাজকন্যা বা রাণী সাজে যারা তাদের বলা হয় রাণী। পাঠক বলা হয় যারা রাজা, মন্ত্রী, রাজপুত্র ও সেনাপতি সাজে। আর যারা নাচ, গান, অভিনয় ও সংলাপ ইত্যাদির দ্বারা দর্শক-শ্রোতাদের হাসায় তাদের বলা হয় সংদার বা সঁংগাল। গানের আসরে বিপক্ষের গোদা কবিকে হারিয়ে দিতেন, তা দেখে তাঁর চাচা লেটো গুরু বজলে করীম বলতেন, দুখু ‘বেঙাচি নয় গোখরো’, তিনি লেটো গানের জন্যে উপাধি পান ‘ভ্রমর কবি বা ভোমর কবি’ হিসেবে।



একসময় সুযোগ বুঝে গ্রামের ‘লেটো’ দলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এতে তার নাম হয়েছিলো। তাছাড়া, সমাজের নানা ধরনের লোকের সঙ্গে মেশবার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। এটা-ওটা জানবার সুযোগও প্রচুর পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু ছন্নছাড়া জীবন তাঁকে হাতছানি দিতে লাগলো-বড় কিছু করার জন্য।



এই লেটো দলে থাকার সময়ই তার কবিতা রচনায় হাতে খড়ি হয়েছিলো। তখন তার বয়স আর কতোই বা হবে, এই তোমাদেরই মতোই। হয়তো বারো কি তেরো, সেই বয়সেই তিনি এমন সব কবিতা রচনা করতেন যে, সকলের তাক লেগে যেতো। তার সে সময়কার একটি কবিতা শোনো-
চাষ করো দেহ জমিতে।

হবে নানা ফসল এতে।।
নামাজে জমি ‘উগালে’
রোজাতে জমি‘সামলে’
কলেমায় জমিতে মই দিলে
চিন্তা কি হে এই ভবেতে।।

চুরুলিয়া, নিমশা আর রাখাকুল-এই তিন গ্রামে তখন ছিলো তিনটি নামকরা লেটো দল। এসব দলের জন্য নাটক রচনার ভার পড়লো বালক নজরুলের ওপর। এতে তিনি দুটো পয়সার মুখ দেখলেন বটে, কিন্তু বাড়ির লোকেরা তার এসব গান-বাজনা করাটা মোটেই পছন্দ করলো না। কারণ তাদের কাছে এগুলো হলো বে-শরীয়তি কাজ।এর ওপর তার দুরন্তপনা তো আছে। গ্রামের লোকজনও শেষে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো।



নজরুলের নিজেরও আর কিছু ভালো লাগছিলো না। লেটো নিয়ে যতোই মেতে থাকুন, মনটা ছিলো তার উড়ু উড়ু। গাঁয়ের লোকের গঞ্জনা আর বাড়ির লোকের ‘ব্যাজার’ মুখ সেই মনকে করে দিলো একেবারে বিদ্রোহী। আর তার পরপরই বিদ্রোহী ছেলেটিই গ্রাম ছাড়লেন। গ্রাম ছেড়ে তিনি গেলেন আসানসোলের এক কয়লার খনিতে চাকরি করতে। চাকরি অবশ্য তার জুটলো না। শেষমেষ চাকরি জুটলো এক রুটির দোকানে। সেখানে খুব ভোরে উঠে তাকে রুটির জন্য আটা মাখাতে হতো। আর তারপর সারাদিন দোকানে বসে রুটি বিক্রি করতে হতো। মাইনে ছিলো মাসে মাত্র এক টাকা। তাতেই তিনি খুশি। কিন্তু তিনি নানান কথা ভাবতে থাকেন দোকানে বসেই। দোকানে বসেই আটা মাখতে মাখতে গা বেয়ে তার ঘাম ঝরতে থাকে। তিনি পেরেশান হয়ে পড়েন। এসময় তার মনটাতে চাংগা করে তুলতে নিজেই গান বেঁধে গাইতে থাকেন-

মাখতে মাখতে গমের আটা
ঘামে ভিজলো আমার গাটা।

তার এই গান শুনে সংগী-সাথীরা তো হেসেই খুন। নজরুল তখন গম্ভীর হয়ে বলতেন, ‘তোমরা আমাকে ঠাট্টা করছো! কিন্তু দেখো, যেমন করেই হোক, একদিন আমি এ দেশের মস্ত বড়ো কবি হবো।’

মনের জোর আর নিজের সাধনার জোরেই, নিজের বিদ্রোহী স্বপ্ন দেখার ফলেই লেটোর এই ব্যাঙাচি পরে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তো আর রুটির দোকানের সেই গায়কটি নন, বড়ো হয়ে তিনি হয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি। তিনিই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/এমএইচ/এইচআর/মে ২৫/১১

No comments:

Post a Comment