আজ কাজী নজরুল ইসলামের ১১১ তম জন্মবার্ষিকী । কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই। কবির "বিদ্রোহী" আজো অন্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৩০৬ (২৫ মে ১৮৯৯)-এর ১১ জ্যৈষ্ঠ চুরুলিয়া গ্রামের আসানসোল-বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহিত্যিক ছিলেন। চুরুলিয়ার জনৈক সূফী সাধকের মাজারের খাদেম ও উক্ত মাজারের নিয়ন্ত্রণাধীন মসজিদের ইমাম কাজী ফকির আহমদ তাঁর পিতা। ফকির আহমদের মৃত্যুর (১৩১৪) পর কাজী পরিবার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হয়। দশ বছর বয়সে গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাইমারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ (১৩১৬) হন। সংসারের চাপে ঐ মক্তবেই তিনি একবছর শিক্ষকতা করেন। বার বছর বয়সে লেটোর দলে যোগদান এবং দলের জন্য পালাগান রচনা করেন। একজন দূরন্ত স্বভাবের বালক হিসেবে তিনি গ্রামবাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর জ্বালাতন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর ব্যক্তি কর্তৃক তাঁকে রাণীগঞ্জের কাছে শিয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি করা হয়। স্কুলের বাঁধা ধরা জীবনের প্রতি তিনি অনাগ্রহ প্রদর্শন করেন। সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার কিছুদিন পর ১৩/১৪ বছর বয়সে স্কুল ত্যাগ করেন ও বাড়ি থেকে পলায়ন করেন।
অতপর আসানসোল গিয়ে তিনি সেখানকার এক রুটির দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে চাকরি গ্রহণ করেন। কাজী রফিজউদ্দিন নামে আসানসোল থানার একজন দারোগা একদিন তাঁর কন্ঠে গান শুনে তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার কাজীর সিমলা গ্রামে নিয়ে গিয়ে ত্রিশাল বাজারের নিকটবর্তী দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯১৪-র ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পরেই তিনি কাউকে কিছু না বলে কাজীর সিমলা ত্যাগ করে রানীগঞ্জে প্রত্যাবর্তন করেন। নিজের ইচ্ছায় পুনরায় শিয়ারশোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ক্লাসে ভাল ছাত্র ছিলেন বলে তাঁর স্কুলের বেতন ও বোডিং-এর আহার ছিল ফ্রি, তদুপরি রাজবাড়ি থেকে মাসিক সাত টাকা বৃত্তি লাভ করেন। প্রি-টেস্ট পরীক্ষাকালে পড়াশুনা ত্যাগ করে তিনি ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগদান (১৯১৭) করেন এবং নৌশেরাতে তিন মাস ট্রেনিং গ্রহণ করেন। অতপর করাচি সেনানিবাসে পোস্টিং লাভ করেন।
১৯২০-এর প্রারম্ভে বাঙালি রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হলে করাচি ত্যাগ করে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় আগমন করেন এবং ৩১নং কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সে সময় দেশে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২) চলছিল। সে অগ্নিঝরা আন্দোলনের পটভূমিকায় পূর্ণোদ্যমে তিনি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। সাপ্তাহিক 'বিজলী'র ২২ পৌষ (১৩২৮) সংখ্যায় তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশিত হলে তাঁর কবিখ্যাতি চারিদিকে বিস্তার লাভ করে। তিনি সাহিত্য সেবার পাশাপাশি সাংবাদিকতার কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। সান্ধ্য দৈনিক 'নবযুগ' (১৯২০)-এর তিনি যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় অর্ধ-সাপ্তাহিক 'ধুমকেতু' (১৯২২) প্রকাশিত হয়। 'ধুমকেতু'র পূজা সংখ্যায় (২২ সেপ্টেম্বর ১৯২২) তাঁর 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় গ্রেফতার হন। কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে রাজদ্রোহের অভিযোগে তাঁর বিচার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আদালত কর্তৃক তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদন্ড প্রদান
(৮ জানুয়ারি, ১৯২৩) করেন এবং ১৯২৩-এর ১৫ অক্টোবর তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।
নজরুল ১৯২৪-এর ২৪ এপ্রিল কুমিল্লার গিরিবালা দেবীর (বিরজা সুন্দরীর) কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা'র (ডাক নাম দুলি। বিবাহোত্তর নাম প্রমীলা) সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯২৯-এর ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে তাঁকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সংবর্ধনা সভায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর সভাপতির ভাষণে নজরুলকে 'প্রতিভাবান বাঙালি কবি' বলে আখ্যায়িত করেন। একই সভায় সুভাষচন্দ্র বসু কবিকে সম্ভাষণ করে বলেন, 'আমরা যখন যুদ্ধে যাব - তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।
১৯৪২-এর ১০ অক্টোবর তিনি মস্তিষ্কের ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। অতঃপর যোগ সাধনায় তিনি মনোনিবেশ করেন। কিছুকাল পরে চৈতন্য ও বাকশক্তি লোপ পাওয়ায় তাঁর সাহিত্য-সাধনার পরিসমাপ্তি ঘটে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় জীবনযাপন করেন। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবদান অনন্য সাধারণ। বাংলা কাব্য-জগতে 'বিদ্রোহী কবি' নামে খ্যাত।
'অগ্নিবীণা' (১৯২২), 'বিষের বাঁশি' (১৯২৪), 'ভাঙার গান' (১৯২৪), 'সাম্যবাদী' (১৯২৫), 'সর্বহারা' (১৯২৬), 'ফণি-মনসা' (১৯২৭), 'জিঞ্জির' (১৯২৮), 'সন্ধ্যা' (১৯২৯) ও 'প্রলয় শিখা' (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থে কবির বিদ্রোহীরূপ পরিস্ফুট। পৌরুষ ও শক্তির চিত্তচাঞ্চল্যে, গণচেতনা ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্খায়, স্বাজাত্যবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহায়, মানবতা ও সাম্যবাদের বাণী বিন্যাসে এসব কাব্যের কবিতাবলী সমুজ্জ্বল। তিনি ঝঙ্কারময় কবিতার পাশাপাশি কোমল-মধুর মানবিক প্রেমের কবিতা রচনা করতেন। 'দোলন-চাঁপা' (১৯২৩), 'ছায়ানট' (১৯২৪), 'সিন্ধু-হিন্দোল' (১৯২৭) ও 'চক্রবাক' (১৯২৯) কাব্যে নজরুলের প্রেমিকরূপ প্রকাশিত হয়।
তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটক রচনায়ও সিদ্ধহস্ত। 'বাধনহারা' (১৯২৭), 'মৃত্যুক্ষুধা' (১৯৩০) ও 'কুহেলিকা' (১৯৩১) তাঁর উপন্যাস। 'ব্যথার দান' (১৯২২), 'রিক্তের বেদন' (১৯২৫) ও 'শিউলিমালা' (১৯৩১) গল্পগ্রন্থ। 'ঝিলিমিলি' (১৯৩০), 'আলেয়া' (১৯৩১) ও 'মধুবালা' (১৯৫৯) নাটক। 'যুযগবাণী' (১৯২২), 'দুর্দিনের যাত্রী' (১৯২৬) ও 'রুদ্রমঙ্গল' প্রবন্ধ-পুস্তক। তিনি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হিসেবে অসাধারণ সুনাম অর্জন করেন। তিনি দেশাত্মবোধক গান, কোরাস গান, প্রেমসঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামী সঙ্গীত, পল্লীগীতি ও হাসির গানের দক্ষ স্রষ্টা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর দেশাত্মবোধক গান ছিল মুক্তিকামী জনতার প্রেরণার উৎস। 'নজরুল স্বরলিপি' (১৯৩১), 'নজরুল গীতিকা' (১৯৩০), 'গুলবাগিচা' (১৯৩৩), গীতি-শতদল' (১৯৩৪), 'সুরলিপি' (১৯৩৪) তাঁর সঙ্গীত-গ্রন্থাবলী। বাংলা একাডেমী থেকে ৪ খন্ডে 'নজরুল রচনাবলী' (১৯৯৩) নামে তাঁর সমগ্র রচনাবলী প্রকাশিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক 'জগত্তারিণী স্বর্ণ-পদক' (১৯৪৫), ভারত সরকার কর্তৃক 'পদ্মভূষণ' (১৯৬০), রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক 'ডি-লিট' (১৯৭৪) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক 'ডি-লিট' (১৯৭৪) ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক 'একুশের পদক' (১৯৭৬) প্রদান করা হয়। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। ১৩৮৩ (২৯ আগস্ট ১৯৭৬)-এর ১২ ভাদ্র এই মহান ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন।
No comments:
Post a Comment